Homepage 64th Issue Editorial পরিবিষয়ী কবিতা Contact Us Contact Us

Poems by Subhro Bandopadhyay | Kaurab ONLINE 64/2024

 

 

শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা

 

 

পুরনো পাড়ায়

 

সুপারি গরাদ গাছ, পুষ্পমোচনের পর চাক ভাঙা সূর্যালোক ফেলে গেছে রাস্তায়। আরেকটু গেলেই একটা পুকুর, গোল চকচকে পাথরের বিরাট মেঝের মত আহবায়ক হয়ে ওঠে গ্রীষ্মের বিকেলে। সেখানেই ঝাঁঝির সঙ্গে পাল্লা দিয়েছিল রুবি মাসির আত্মহত্যা। ভেসে ওঠা এক কোমর চুল। একটু পরেই পাখালির ছটফটে শব্দ, অবাধ্য মনে পড়াগুলো, মৃত পশুর উপর হায়না।

 

ভেবেছিলে দেখা হবে, বাবা মা পুরনো সময়। আসলে নিরুদ্দিষ্ট সেখানেই ফিরতে পারে যেখানে কেউ কোনদিন অপেক্ষায় থাকে না।

 

 

তালঢেঙা পাভেল

 

আমাকে আমেরিকা মহাদেশের প্রাচীনতম ঔপনিবেশিক শহর সান্তো দোমিঙ্গোর বন্দরে দাঁড়িয়ে বলেছিল তার শরীরে কুড়ি শতাংশ তাইনো জিন। তাইনো প্রাচীনতম এক জনগোষ্ঠী, কলম্বাসের ঘাতক আক্রমণ থেকে বাঁচতে তাদের বিস্তীর্ণ শুকনো ঘাস জমিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। প্রায় অর্ধেক দ্বীপ খড়ের সূর্যের মতো জ্বলেছিল সপ্তাহের পর সপ্তাহ পাভেল বলেছিল আসলে দরিদ্র মানুষের কোন তাড়া থাকেনা তাদের ডেঁও পিঁপড়ের ঝাঁকে ঢাকা মুখ তছনছ করে দিতে পারে যেকোনো প্রভাতী পুষ্পের নাক্ষত্রিকতা

 

 

গালিব লিখেছিলেন

 

দীর্ঘশ্বাসের প্রার্থনা সফল হতে গোটা জীবন লেগে যায়। আমি দেখি বসবাস বালিঘড়িদের সাম্রাজ্যে যেখানে প্রতিদিন বেড়ে ওঠা থেঁতলানো ঘাসের গন্ধ শোক বাতাসের দৃঢ়তায় আঁচড়ে দেয় সর্বাঙ্গ। মাথা নামালেই সামনে প্রস্তর নির্মিত জ্যোৎস্না, অশ্মীভূত সময়ের ছায়াপাখি ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে সমস্ত নিঃশ্বাস। গালিব আসলে একটা মৃত শহরের নাম যেখানে বাষ্পের ফিতে সেলাই করে রাখে সমগ্র আকাশ, যা আসলে এক আলোর ডেলা, এক তামাটে বাতাস, কোন প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রের খোল থেকে বেরিয়ে আসা বিকেল।

 

 

ঠাকুমা বারাণসীতে মরতে চেয়েছিল

 

কারণ সেখানে তখন ও জল বহমানতার হিসেব রাখত ঝাঁকড়া গাছের পাতায় বাতাসের আক্রমণের পরিমাণ মতো। ঠাকুরমা জানত মানুষের শরীর ভালোবাসা ছাড়াই বাঁচে বেশিরভাগ জীবন তাই বারাণসী নামক নক্ষত্র মন্ডলীর তলায় যাঁরা বংশপঞ্জি লিখে রাখেন তাঁদের প্রতিটা শব্দ পেস্তার ফাঁপা খোলার তৈরি। বারাণসী এক মৃত প্রজাপতির ডানা যে অপেক্ষা করছে টিকটিকির জিভের জন্য, যেমন অ্যালুমিনিয়ামের বাসন মেলে রাখা বর্ষালোকিত পুকুর পাড়ে নিজের ব্যর্থতাগুলো ছড়িয়ে থাকা ডুবো থালার ভাত যা ঠুকরে খাচ্ছে মৃগেল-দুপুর।

 

 

আরতুরো এক তরুণ বুল ফাইটার

 

যে মেহিকো থেকে মাদ্রিদে এসেছিল ষাড়ের লড়াইয়ের প্যাঁচ-পয়জার শিখতে। প্রতি শনিবার তার একটা করে অভিসার ব্যর্থ হলে গজ গজ করত স্প্যানিশ প্রবাদ খরগোশ বলে বেড়াল গছিয়ে দিয়েছে। আমি দেখতাম প্রতি রবিবার সেই সব বিড়ালের হিংস্র ছায়া সকালের মতো নরম অক্টোবর। যেখানে স্পর্শই ত্বকের একমাত্র ঈশ্বর। দেরি করে ফোটা সূর্যালোকের সামনে আমাদের মাথা যাবতীয় কথার মধ্যে জোনাকি ঠাসা বাক্যবিন্যাস মেলে ধরত ওপড়ানো চোখের মত হলুদ বাল্বের তলায়। আমি টের পেতাম সমগ্র মাদ্রিদ শহরের কেন্দ্র জেগে উঠছে অক্টোপাসের শুঁড়ের গলি ধরে। আমি বুঝতাম জীবন যখন বাধাই ছেঁড়া বইয়ের মত মাঝখান থেকে খুলে আসে তখন মেনে নেয়াই শ্রেয়

 

 

খুয়ান রামোন খিমেনেস

 

যাঁকে বাঙালি হিমেনেথ বলে জানে তিনি তার অজস্র প্রেমিকাদের মধ্যে একজনকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সেই মহিলার বসার ঘরের সোফায় লাল একটা তাকিয়া ছিল বলে। পরে আবিষ্কার হয়েছে সন্তপ্রতিম কবির পার্থপ্রতিম লীলা সন্ন্যাসিনীদের সঙ্গে। এমনকি কবির নিজের আঁকা সেইসব নারীদের নগ্নচিত্র। যেভাবে রিলকে খুঁজতেন অদৃশ্য সুরের মৌমাছি যেভাবে রবীন্দ্রনাথের ভ্রমর ঘর ও গুনগুনিয়ে আসা ঝড়ের রাত যার সঙ্গে অবধারিতভাবে বসে যায় অভিসার তুমি ইত্যাদি শব্দ, যাদের সঙ্গে নাড়ির যোগ মফস্বলের স্টেশনের সাইকেল স্ট্যান্ডে শেষ ট্রেন ঢোকার আগে তাস বাঁটার শব্দ। যেভাবে সবুজ কালিতে লেখা নেরুদার চিঠিগুলো পরপর ঝরে পড়েছিল যেভাবে এখনকার কিশোর মাতৃভাষাহীন ঘুরে বেড়ায় সংখ্যার জগতে, যেভাবে এই বালি ঘড়ির স্তুপে ঢাকা বিকেলগুলো হারিয়ে যাচ্ছে আমার স্নায়ুর টানে, আমি চিৎকার করে বলছি পুষ্প সচেতন কোন হাত আমায় স্পর্শ করুক। অথচ আমার এই কুৎসিত ধ্যাবড়া মাঝ বয়সের মুখ আয়নায় আটকে রাখা পুরনো টিপ তুলতে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে রোগা কাঠবেড়ালির শীত ধূসর মনে

 

 

মীর তকি মীর লিখেছিলেন

 

তুমি কবি চুপ করে থেকো না বহু জীবন শব্দহীনতার চাদরের তলায়।  আমি আমার ভাঙা আঙুলের চাপে তুলে আনতে চাইছি রেললাইনের খোয়া যাদের গায়ে অযথা রক্তের ছিটে লেগে আছে, যেমনটা বা বিশ্বকোষ দিয়ে তৈরি কোন পৌরাণিক শহরে সমস্ত ছায়া সারিবদ্ধ, জং ধরা পেরেক দিয়ে তাদের বর্গীকরণ করা হয়েছে। যেমনটা বা সমস্ত কালো গান জড়ো হয়েছে সুরেলা বিকেলে অথবা শিশুদের সমস্ত রাস্তা অবধারিত প্রবেশ করেছে থেঁতলানো কাঠবিড়ালি ভরা গলিতে

 

 

ওয়ালীউল্লাহ লিখেছিলেন

 

নিরাকার নিদ্রাবিভূত, যেমন এই খেলনা শহরের রাক্ষস বীথিকা জুড়ে প্রতি দুপুরের গ্রীষ্ম শাসিত মানুষ  গ্রামচ্যুত, দীর্ঘশ্বাসের বাষ্প কাচের অভাবে বাসের জানলায় জমতে পারছে না। যেমন আহত কুকুরের মত জড়োসড়ো প্রতিটা রাস্তায় ও জোৎস্না গন্ধের ধ্বংসাবশেষ জুড়ে আমার জলের শরীর মোমের গরম নিঃশ্বাস ঘষটে নিয়ে চলেছে আমারই মৃতদেহ, আমাকে দংশন করছে আলোর সরীসৃপ দাঁত

 

 

লোদি বাগানের প্রাচীন সমাধি

 

দেখে ওক্তাবিও পাস এর মনে হয়েছিল পাখি উগরে দেওয়া গম্বুজ। অথচ আমাদের সময় সাহিত্যে বোধহয় কিছু বলবার থাকবে না যেভাবে প্রতিটা গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা তৈরি করে নেবে নিজস্ব ইস্কুল। আমাদের প্রতিটা চলার ফাঁকে ছড়িয়ে থাকবে ঘড়ির কাঁটা। রহস্য উপন্যাসের মাঝখানের অংশ জুড়ে গড়ে উঠবে সন্তদের উপদেশ কাব্য যেভাবে মাঝবয়সী পুরুষ সিনেমা হলে পরচুলা ঠিক করে। কালো পোকাদের বিরুদ্ধে দাবার বোর্ড সাজাতে গিয়ে ঠিক ধরে ফেলা যাবে ধর্মের ফিকিরগুলো। মৃত ভাষায় লেগে থাকবে রক্তের গন্ধ পাশে ছুরি ও সুষুপ্তির ধারালো টুকরো

 

 

আর যেহেতু

 

আমার ভাষার অস্তিত্ব কেবলমাত্র মৌখিক ও গরিব তাই এক ধরনের বেপরোয়া বাক্য বিন্যাস আমাকে আচ্ছন্ন রেখেছে যেভাবে ঘুম ভাঙার পর মিনু মাসি পাখির বাসার গন্ধ পেত। যেহেতু কবির কোনো সামাজিক ভূমিকা নেই তাই এই মুহূর্তে মীর তকি মীর ছাড়া আর কাউকে মনে পড়ছে না, জেলখানায় তবু খোলা আকাশের স্বপ্ন দেখা যায় কিন্তু বিষাদের কয়েক খানায়? মাথা নামি আনি। বেতো আঙুলের জন্য ডাইক্লোফেনাক খাবার সময় ভাবি এই ওষুধ সমস্ত শকুনকে নিশ্চিহ্ন করেছে এ দেশে। তারপর ঘোর লাগে দেখি বাংলা ভাষায় রচিত সমস্ত উপন্যাসের নাম গৃধিনী চরিত। তারপর সশব্দে জানলা খুলে যায়। ঝড়ের রাত, পরানসখা প্রভৃতি শব্দের ভিড়ে আমার প্রতিটা অক্ষর মোরগের লড়াই এর ধুলোয় পড়া তাদের নখের শ্রেষ্ঠ আঁচড়