Homepage 64th Issue Editorial পরিবিষয়ী কবিতা Contact Us Contact Us

Poems by Souva Chattopadhyay | Kaurab ONLINE 64/2024

 

 

শৌভ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা

 

 

অনিশ্চিত সংলাপগুচ্ছ

 

বস্তুসমূহের এই অস্থির বিন্যাস আর ক্ষয়, অবিরাম যাতায়াতের উদ্দেশ্যহীনতায় ভরে ওঠা রাস্তার শূন্যতাটুকু, আমাদের যাবতীয় উদযাপন, ব্যর্থতা, অহংকারএই সবকিছুই, কোথাও, কোনও এক অদৃশ্য ঘড়ির কাঁটাকে প্রাণপণে সচল রাখার চেষ্টা বলে মনে হয়েছিল আমার। মনে হয়েছিল, দর্শকবিহীন এই নাটকের ভেতর আমাদের নিরুপায় ভূমিকাটুকুখুব আস্তে আস্তেএকটা মস্ত পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে দিচ্ছে সময়ের পাথর, যেভাবে অনির্দিষ্ট বস্তুর ভারে বেঁকে যেতে থাকে আলো আর অন্ধকার, কুঁড়ি থেকে ফুলের অনুচ্চার্য ব্যবধানটুকু ক্রমশ এক প্রশ্নহীন আলোয় ভরে ওঠে, আর পুড়িয়ে দেয় চোখের পাতা

 

তবু, আমাদের আলোয় পুড়ে-যাওয়া চোখগুলো, শেষ মুহূর্ত অবধি, আমরা খুলে রেখেছিলাম। আমরা দেখেছিলাম, সময় ফুরিয়ে যাওয়ার পর যা পড়ে থাকে, তা আসলে এক অপরিবর্তনীয়, স্থির, পাথুরে অন্ধকার

 

স্মৃতিহীন, ভাষাহীন, পরম্পরাহীন

 

 

কখন যে বড়ো বড়ো হোর্ডিঙে, ব্যানারে ও পোস্টারে ঢেকে গিয়েছিল শহরের রাস্তাঘাট, আমরা বুঝতে পারিনি। ছবিগুলো ক্রমশ আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। এমনকী, বাস্তবের চেয়েও অধিক বাস্তব।

 

ধরুন আজ, এই মুহূর্তে, হঠাৎ ধ্বংস হয়ে গেল সভ্যতা, মুছে গেল যাবতীয় ছবি-গান-কথা। নিমেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল সমুদয় শিল্প ও গ্রন্থাবলী, অর্থাৎ আমাদের যা-কিছু অহঙ্কার। অথচ, মাটির নিচে কোনও এক গোপন কুঠুরিতে রাখা ছিল বলে, টিঁকে রইল একমাত্র এই বিজ্ঞাপনগুলি। কল্পনা করুন, আরও দূর ভবিষ্যতে, যখন আবার পৃথিবীতে সভ্যতার পত্তন হবে, আর তাদেরই কেউ মাটি খুঁড়ে তুলে আনবে অতীতের এই অত্যাশ্চর্য নিদর্শনগুলি, তখন কী প্রবল বিস্ময়ে ও ঈর্ষায় সবুজ হয়ে উঠবে তাদের মুখ! কী বিনম্র শ্রদ্ধায় তারা বারবার স্মরণ করবে এই অতিমানবিক সভ্যতাকে, যেখানে প্রত্যেকটি পুরুষ সবল ও সুগঠিত, যেখানে প্রত্যেক নারীর ত্বক শুভ্র ও কোমল, যেখানে সমস্ত মুখ আনন্দে উজ্জ্বল!

 

আমরা কি ক্রমশ পরিধির দিকে সরে যাচ্ছি? আমরা কি পরাজিত, দৃশ্যের কাছে?

 

 

তখন আকাশ থেকে, আমাদের মাথার ওপর ঝরে পড়তে থাকে কালো কালো ছাই। হঠাৎ বৃষ্টি নামল, আর তার ফলে, সমস্ত শরীর জুড়ে ফুটে উঠল বসন্তের গুটির মতো পুঁজ-ভর্তি ফোসকা। চারিদিক নিস্তব্ধ, শুধু একটা খসখসে হাওয়া, মাঝেমধ্যে পাক খেয়ে উঠে, আবার ঝিমিয়ে পড়ছে।

 

ধ্বংসের অনিবার্যতাকে প্রশ্ন করা অর্থহীন। একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে, আসলে আমরা বুঝে নিতে চাইছিলাম আমাদের রাস্তাগুলো কীভাবে একই বিন্দুতে এসে মিলে গেল। কীভাবে একটা ঐকান্তিক দৃশ্যের কাছে পৌঁছনোর তাড়নায়, একদিন লক্ষ করলাম, আকাশ থেকে আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে সূর্যের আলো, পাখির ডানা থেকে ঝরে পড়ছে পূতিগন্ধময় মাংস আর পালক

 

নৈঃশব্দ্যের চোয়াল মাড়িয়ে ফিরে আসার সময়ে, আমাদের পায়ের তলায় কড়মড় করে উঠেছিল নুড়ি-পাথরের দাঁত। দেখেছিলাম, অন্ধ বৃদ্ধা কাঁধে করে বয়ে নিয়ে চলেছেন তাঁর বিকলাঙ্গ দৌহিত্রকে, আর সে তার শক্ত মুঠোয় আঁকড়ে ধরে আছে একটা মুণ্ডুহীন পুতুলের হাত।

 

 

আপনার কথা শুনতে-শুনতে, একসময়ে, আমি খেই হারিয়ে ফেলি। তখন কথার চেয়েও, আপনার ঠোঁটের বাঁদিকে ওই কালচে-বাদামী তিলটির রহস্য উদ্ঘাটন করা, আমার কাছে বেশি জরুরি বলে মনে হতে থাকে। মনে হয়, অল্প-উঁচু চোয়ালের নড়াচড়া, গালের মাংসপেশীর কুঞ্চন, থুতনির ভাঁজএই সবকিছুর রহস্য যদি আগাগোড়া ভেদ করতে না-পারি, তাহলে আপনার কথার মর্মোদ্ধার করা কিছুতেই সম্ভব নয়।

 

অথচ, এতকিছু করতে গিয়ে, সময়ের খেয়াল থাকে না। সূর্য ডুবে গেলে আপনার মুখ, আচমকাই, একেবারে অন্ধকার হয়ে যায়। তখন মাথার ভেতর, একটা অন্য জগৎ নিয়ে হেঁটে-চলে বেড়াই। তার ঝমঝম শব্দ, বস্তুর অকল্পনীয় আকার আর রঙ, আমাকে পাগল করে দিতে থাকে। বেপরোয়াভাবে, আমি খামচে ধরি আপনার জামার আস্তিন, আর বারবার ভুলে যাই আপনার নাম।

 

ভাবি, সমস্ত পরিবর্তন আর রূপান্তরের আড়ালে, কোথায় সেই অচঞ্চল মাটি? সমস্ত গাছের মধ্যে, কোথায় সেই একমাত্র গাছ? অসংখ্য দৃশ্যের এই ধারাবাহিক পরম্পরার ভেতর, সেই ছবিখানি কোথায়, ভাষা যাকে সম্ভব করেছে?

 

 

পুরাণ ও মহাকাব্যে উল্লিখিত মহাপ্লাবনের কল্পনার মধ্যে, আমার মনে হয়, এক ধরণের অহেতুক আশাবাদ প্রচ্ছন্ন রয়েছে, যেহেতু জল, একইসঙ্গে, জীবনের ধাত্রীও বটে। মনে আছে, বহুদিন আগে লিখেছিলাম—‘ধ্বংস আসলে একটা শাদা পাতা/ আমি তাকে বাসনায়, অক্ষরের সাজে/ সাজিয়ে তুলেছি মাত্র।তখনও বুঝিনি, ধ্বংস মানুষের ভাষাকে কতদূর তামাদি ও অর্থহীন করে তোলে, কীভাবে দপ্‌ করে নিভে যায় সেই আশ্চর্য প্রদীপযা বস্তুকে আলোকিত করার পাশাপাশি, নিজেও একইসঙ্গে, দৃশ্যমান হয়।

 

আমরা কয়েকজন তাঁবুর বাইরে এসে বসেছিলাম, শূন্যতার চারিদিকে গোল হয়ে।  কারোর মুখেই কোনও কথা ছিল না। অবশেষে, মুনিয়া গান গেয়ে ওঠে। আমার ডানদিকে, দুহাঁটুর ফাঁকে মুখ গুঁজে বসেছিল গণি। তার পিঠ কেঁপে-কেঁপে উঠছিলঠাণ্ডায় না কান্নার দমকে, বুঝতে পারিনি।

 

অন্ধকার এভাবেই গান হয়ে উঠেছিল একদিন।  অন্ধকারের জিভ থেকে আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম আমাদের ভাষা।

 

 

“…snow falling faintly through the universe, and faintly falling, like the descent of their last end, upon all the living and the dead.”

 

দীর্ঘ এক পতনের ছায়া, তার তলহীন অনিবার্যতা ও পিছুটান নিয়ে, ক্রমশ আরো ঘন হয়ে ওঠে। ঘন হয়ে ওঠে এই অচেনা বিকেল। কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা, কোন অনির্দেশ্য স্থিতিহীনতায়? চারিদিক ক্রমশ আরো শীতল, অন্ধকার ও স্তব্ধ হয়ে আসছে।

 

বরফ পড়ছে। লক্ষ করি, জামার হাতায় আর কাঁধে বরফের গুঁড়োস্যাঁতসেতে, ভিজে। ঝেড়ে ফেলি। আসলে তুষার, একটি অতিক্ষুদ্র ধূলিকণা বা পরাগরেণুর চারিদিকে, জমে কঠিন হয়ে-যাওয়া জলীয় বাষ্পের স্ফটিক। এদের বিচিত্র জ্যামিতিক আকার, অনুপম নকশা ও সুক্ষ্ম কারুকার্য, যারপরনাই বিস্ময়কর। এবং প্রত্যেকটি নকশাই নাকি আলাদা, অদ্বিতীয়। খালিচোখে তাদের দেখা যায় না।

 

তবু ওই আশ্চর্য নকশার কেন্দ্রে লুকিয়ে থাকা বালুকণার আণুবীক্ষণিক অস্বস্তিটুকু আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। এবং আপনার চোখের মণি থেকে উঁকি দেয় শূন্যতার চেরা জিভ, বিলুপ্ত শহরের স্মৃতিহীন পূর্বধার্যতা

 

 

ঘটনার এই অপরিবর্তনীয় একরৈখিকতা থেকেই জন্ম নেয় সময়ের ধারণা। তথ্যের ওপর জমে ওঠা আরো তথ্যের ভার, স্মৃতির ওপরে আরো স্মৃতিএছাড়া, সময়ের আর কোনো তাৎপর্য নেই, থাকতে পারে না।

 

কেননা আমি দেখেছি, মানুষ একইসঙ্গে জীবিত ও মৃত; সবুজ ও জলময় একটি গ্রহ, গোটা একটা সৌরজগৎ, কীভাবে জন্ম নিচ্ছে ও ধ্বংস হচ্ছে যুগপৎ; বসন্তগুটির মতো ওই গণনাতীত নক্ষত্রপুঞ্জ, দূরবর্তী গ্যাসের বিথার, ক্রমাগত জ্বলছে আর নিবছে, বারবার প্রসারিত হচ্ছে আর নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাচ্ছে ফের। মস্ত এক হাঁ-মুখের ভেতর থেকে উদ্গত এই চীৎকারকেই, একদিন, আমরা বিশ্বরূপ বলে জেনেছি।

 

তুমি কি দেখতে পাচ্ছ, দূরে, ক্রমশ লাল হয়ে উঠেছে আকাশ? অস্থির এক হাওয়াখসখসে, রোমশতোমাকে আরো কোণঠাসা করে ফেলছে, আড়ষ্ট হয়ে আসছে তোমার জিভ। বেঁকে  যেতে-যেতে, সমস্ত পথই এখন বৃত্তাকার, এবং এক অন্ধকার কেন্দ্রের দিকে অভিসারী সমস্ত আলো

 

 

সমস্ত আলোর কেন্দ্রে সেই এক বিস্ফারিত অন্ধকার, দৃষ্টিহীন চোখের মণির মতো, আচমকা দপদপ করে ওঠে। ধীরে ধীরে বিশৃঙ্খলা বাড়ছে, আরো শীতল ও কঠিন হয়ে আসছে এই সীমাহীন ক্ষমতার নৈরাজ্য

 

হয়তো নিয়মকে শাশ্বত ও কালাতীত বলে ধরে নিয়েছিলাম বলেই, সময় একদিন আমাদের টুঁটি টিপে ধরল, আর ঘাড় ধরে টেনে আনল সেই ভাষাহীন হাড়িকাঠের সামনে, যেখানে রক্ত-পিছল মাটির ওপর একটি মুণ্ডহীন ধড় কেবলই আছাড়ি-পিছাড়ি খাচ্ছে

 

একটা শূন্যের গায়ে দাগা বোলাতে-বোলাতে, আমরা ক্রমশ তাকে আরো উজ্জ্বল, আরো গভীর করে তুলছি

 

যেভাবে কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে পাক খেতে-খেতে ঢুকে যায় বস্তুপুঞ্জ আর আলো, ঠিক সেভাবেই এই অফুরন্ত প্রাচুর্য, অমেয় পণ্যের ভারে ক্রমশ বেঁকে যাচ্ছে দেশকালের জ্যামিতি, ক্রমশ গুটিয়ে আসছে ইতিহাস আর ঘটনার ক্রমপরম্পরা, বাবেল টাওয়ারের মতো দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে আমাদের ভাষা, আমাদের চীৎকৃত উল্লাসের স্বরহ্যাঁ, আমরা পরাজিত