Art-Essay & Poetry by Debesh Goswami, Santanu Bandopadhyay | Kaurab ONLINE 63/2024

 

 

বহুশিল্পবাদ প্রকল্পঃ

স্থাপনকলা-কবিতা

 

দেবেশ গোস্বামী ও শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

নৈঃশব্দের ফুল

দেবেশ গোস্বামী

 

আমার ইন্সটলেশান, ফটোগ্রাফি, ভাস্কর্য, ড্রইং – নানা ক্রিয়াকলাপের অনেকটা অংশ জুড়ে প্রকৃতির সাথে বিষয়বস্তু হিসাবে উঠে এসেছে ব্যক্তি এবং সমষ্টিগত পরিচয়ের প্রশ্ন। আমি এমন এক জগতে বাস করি যেখানে ভারতীয় সংস্কৃতি ও পাশ্চাত্য ইউরোপের মধ্যে নিজের অস্তিত্বের বাস্তবতার সঙ্গে নিজেকে ভাগ করে নেই, যেমন চিরস্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী জীবন, এই দুইয়ের ভেতর।

প্রকৃতি সামগ্রিকভাবে আমাকে অনুপ্রাণিত করে – তারই দৃশ্যমান উপাদান ‘ফুল’ আমাদের সংস্কৃতি ও জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে। যার নানা প্রকাশ বা উপস্থিতি শুধু প্রকৃতি এবং মানুষের মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্কই স্থাপন করে না, বরং এর উপস্থাপনা অতীতে ও সমসাময়িক শিল্পকে এক অনন্য মাত্রা দান করে।

নব্বই দশকের শেষের দিকে, ফিরে দেখা মন্দিরের মধ্যে কালো পাথরের মূর্তি, বিপুল ফুলের মালায় আবৃতপ্রায় – এক অসাধারণ উপলব্ধি! সেই থেকে শুরু আমার শিল্পসৃষ্টিতে ফুলের ব্যবহার। খুঁজে পেতে চাই মূর্তি ও ঐতিহ্যবাহী ফুলের সংস্কৃতি ও আচারের মধ্যে একটা সম্পর্ক। কিভাবে ভাস্কর্য মাধ্যমকে তার গতানুগতিক সীমাবদ্ধতার বাইরে ঠেলে দেওয়া যায়।

প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করতে, প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে সংযোগ করতে – ফুল যেন আমাকে শক্তি যোগায়। অনুশীলনের সময় উদ্বেগ ভুলে এক শান্ত অবস্থায় স্থিত হয় মন। ফুল দিয়ে কাজ যেন পূর্ণতার একটি আনন্দদায়ক অনুভূতিকে জাগিয়ে তোলে। ফুলের স্বাভাবিক সৌন্দর্য, রঙ, আকৃতি, গঠনের বৈচিত্র্য মনকে আকৃষ্ট করে, হৃদয় পূর্ণ হয়, বিশ্ব হয়ে ওঠে রহস্যময় – অনুভূত হয় ফুলের সঙ্গে আত্মার সংযোগ। শিল্পের ইতিহাসে ফুলের প্রতীকী উপস্থিতি দেখা যায়, বিশেষ করে ডাচ্‌ চিত্রকলায় – যা জীবনের ভঙ্গুরতা বা সীমাবদ্ধতার সাক্ষ্য দেয়। এছাড়াও, ফুলকে নিয়ে জড়িয়ে আছে নানান ভাবনা। শুধু আধুনিকতা ও পরিবেশগত অগ্রগতিই নয়, সমসাময়িক শিল্পে ফুলকে দেখা যেতে পারে সম্ভাব্য বিশ্বের নতুন সমীকরণে।

‘নৈঃশব্দের ফুল’ ধারাবাহিক কাজগুলি বিগত দশকে নানা দেশে, নানা সময়ে, কখনো পাবলিক স্পেসে বা কখনো যাদুঘরে প্রদর্শিত হয়েছে। যেখানে ভূ-রাজনৈতিক, নৃতাত্বিক, পরিবেশগত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এগুলি ভাব ও যুক্তির সংমিশ্রণে সৃজনশীল প্রক্রিয়ার বিচিত্র প্রকাশ এবং স্থান, কাল ও বস্তুর জটিল আবর্তের মধ্যে সৃষ্ট।

শিল্পে জাগতিক ইচ্ছা বিকশিত হয়। কখনো নৃতাত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে কাজের মধ্যে প্রকৃতির সঙ্গে সাম্যের এ-যেন এক পারস্পরিক সম্পর্ক খোঁজার প্রচেষ্টা। পরিবেশের উপস্থিতি নির্ধারণ করতে ফুল এখানে প্রধান উপকরণ বা কাজের মাধ্যম – যা প্যাটার্ন বা অলংকারিক বস্তু নয়।

I am what I am’ (Je suis Ce que je suis) ২০১০, কোলকাতা বিড়লা একাডেমি, ‘Read it, Seen it, Vienna in early Spring’, ২০১৪, ভিয়েনা ইউনিভারসিটি অব অ্যাপ্লায়েড আর্ট, অস্ট্রিয়া, ‘I am what I am’, ২০১১, প্যারি মিউনিসিপ্যালিটির চত্বরে বিশাল মারিয়ানার মূর্তি (ফ্রান্স প্রজাতন্ত্রের প্রতীক) ফুল দিয়ে মোড়ানো হয়। যখন আমি ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার প্রতিনিধিত্বকারী মূর্তিকে ফুল দিয়ে আবৃত করি, ফুল এখানে যেন স্বাধীনতার প্রতীক – যা সংরক্ষণের প্রশ্নটি উত্থাপন করেএই ধরণের বিন্যাসের মাধ্যমে একটি প্রতীকী প্রক্রিয়া শুরু করা – যার রসদ যোগায় সময় আর স্থান, স্ট্যাচুটি এখানে কোন জড়বস্তু বা Object নয়, যার উপস্থিতি জাগ্রত করে প্রতীকী জাতীয়তাবাদ ও সাম্যকে

এই কাজগুলিতে আমার অনুভূতিগুলি প্রকাশ পায় মেজাজের ভিন্নতায়; যা কখনো ‘আমি’ একবচনে, কখনো বা প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত একটি অনন্য বা ক্ষুদ্র বিন্দু হিসাবে। আমি কী? ‘Ce que je suis’ – আমি কি নিজের উপস্থিতি? শুধুই শরীর? নাকি শারীরিক কাঠামোর বাইরেও একটা আমি ধরা দেয় ভাষার, সংস্কৃতির বা ভৌগোলিক অবস্থানের চৌহদ্দি পার করে?

ফুল দিয়ে মোড়ানো বাস্তবতা এবং স্বপ্নের মধ্যে একটা ভাবনা – যা অন্তর্দৃষ্টির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে – যা দৃষ্টির গভীরতর প্রদেশ থেকে জাগিয়ে তোলে তার নিজের অস্তিত্বের পরিচয়। প্রকৃতপক্ষে, ‘I am what I am’ (‘আমি যা আমি’) শিরোনামে Installation টি আমাদের এই বিশ্বায়নের যুগেও চারপাশের বস্তুসমূহের আরোপিত পরিচিতিগুলিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। শুধু ‘একক সময়ের’ ব্যবধানেই নয়, অথবা কেবলমাত্র ‘একক সংস্কৃতিতে’, আমরা কি সত্যিই পারি ভৌগোলিক সীমানার বাইরে যেতে? এক্ষেত্রে, প্রখ্যাত ফরাসি শিল্প ঐতিহাসিক, শিল্পবেত্তা Jean-Mare Poinset’র আমার শিল্প সম্পর্কে মন্তব্য :

“...... কাজগুলি অভিব্যক্তির সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় রূপ – যেখানে সকল শৈলী, সকল সংস্কৃতি ও সকল কালের মিলিত প্রকাশ। ফুল দিয়ে স্ট্যাচু বা মূর্তিকে ঢেকে দিয়ে ‘আমি’র পার্থক্যগুলি উপলব্ধি করার চেষ্টা – যা একই সর্বনামের পেছনে লুকিয়ে আছে।”

প্রমিতকরণের বৈশ্বিক সমাজে সমস্ত সংস্কৃতি তাদের সহযোগিতা দিয়ে সমাজকে আলোকিত করার দাবি করে। এমন ম্যাক্রোকজমের সৃষ্ট যে ব্যক্তি, যার ম্যাক্রোকজমের প্রতিটি ইউনিট বিশ্বব্যাপী তথ্য দ্বারা পরিচালিত, তাকে, অবশ্যই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। এটি খোঁজার পথে সতর্ক থাকতে হবে – আমাদের স্বভাব গতিতে চলার পথে আমাদের নিজস্ব শিকড় না হারিয়ে যায়, যা আমাদের ইতিহাস এবং পূর্ব প্রজন্মের সাথে সংযুক্ত করে। কারণ, অতীত ছাড়া ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব।

২০১৭, জুলাই, পার্ক মঁসুরি, প্যারি – একটি গ্রিক ভাস্কর্যের (ভেনাসের মূর্তি) মুখ, কাঁধ ও স্তন সাদা ফুল দিয়ে আবৃত করা হয় – যা পবিত্রতার প্রকাশ, যা বাহ্যিক সৌন্দর্যকে মহিমান্বিত না করে বরং আত্মার অভ্যন্তরীন সৌন্দর্যকে তুলে ধরার ইঙ্গিত দেয়। ফুলের মত পচনশীল উপাদান ব্যবহার করে এই কাব্যিক আবেগ – বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরীন, বস্তুগত এবং আধ্যাত্মিক, প্রকৃতি ও সংস্কৃতি এদের ভেতরকার বাইনারি সম্পর্কগুলিকে পুনরায় পরীক্ষা করা।

অপর একটি মূর্তি (Le Naufrage), Installation- এ দেখানো হয়েছে দৃষ্টি নিবিয়ে ফেলা, যেন মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া ব্যক্তির মুখ মুছে ফেলা হয়েছে। এই মুখটি লুকিয়ে রাখা অপ্রতিরোধ্যকে প্রকাশ করার একটি উপায়। বিষাদ, যা সমস্ত উপস্থাপনাকে ছাপিয়ে যায়। এছাড়াও, আমাদের এই চাক্ষুষ উপলব্ধির বাইরে এই মহাবিশ্বকে আমি আমার আবেগময় আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বুঝতে চাই। খুঁজে পেতে চাই আমাদের মধ্যে – যার সঙ্গে সম্পর্কিত মহাজাগতিক রহস্য। এই কারণেই, স্বাধীনতা বা প্রজাতন্ত্রের মত মহান প্রতীকী মূল্যবোধ থেকে দেবতাদের মূর্তি – সবই আমার উপস্থাপনার বিষয়, আমার সৃজনশীল আবেগের উৎস।

২০১০ সাল, কলকাতা বিড়লা একাডেমি এন্ড কালচার আয়োজিত ‘Beside Paris’- শীর্ষক প্রদর্শনীতে সুদীর্ঘ পাথরে খোদিত বেণুমাধবের মূর্তি ফুলে ঢেকে দেওয়া হয়। Installation টি প্রতীকী। ঐতিহ্যগত আচার-অনুষ্ঠান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মূর্তিটির নীচের দিক থেকে একটি অংশ ঢেকে দেওয়া হয় – যা মানুষের হৃদয় থেকে আসা নৈবেদ্যর প্রকাশ – যা মূর্তির শরীরে কোমল আচ্ছাদন অথচ ভঙ্গুরও বটে! অন্যের প্রতি ভালোবাসা এখানে প্রশ্নবিদ্ধ? ভগবানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মূর্তিতে ফুল দেওয়া না আত্মানুসন্ধান? এছাড়াও, যার একটি ক্ষণস্থায়ী জীবন রয়েছে, সেই ফুল পাথর থেকে ভিন্ন একটি জীবনচক্র প্রকাশ করে।

২০১৪ সাল, ভিয়েনা, ‘I am what I am’ ইন্সটলেশানটিতে একটি করুর (little angel) প্রতিনিধিত্ব করে। তার হাতে নিজের সমান মাপের একটি বড় ক্রস, যার মাথাসহ উপরের অংশ ফুলে আচ্ছাদিত। যা সমসাময়িক সমাজের কাজের সঙ্গে সম্পর্কিতখ্রিস্টধর্মে দাতব্যের (charity) ধারণা একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গীর প্রকাশ – যা পশ্চিমা ইতিহাসের একটি বড়ো অংশ এবং প্রভাবশালীদের সমর্থন পায়। এই ধারণার বাহক রক্ষণশীলেরা। অন্যরা বরং এর বাইরে গিয়ে সকলের মুক্তি এবং সমাজকে উন্নীত করেন – যা প্রশ্নবিদ্ধ হয় এই শিল্পকর্মে। ‘নৈঃশব্দের ফুল’ উপস্থাপনাগুলি সময়ের প্রেক্ষিতে বস্তু ও স্থানের বিচিত্র প্রকাশ। মনের অতলে হারিয়ে যাওয়া ছন্দ ও প্রতীকী দৃশ্যের সংযোগকে অনুবাদ করে – যা আমার সৃষ্টির শৈল্পিক ও কৌশলগত চ্যালেঞ্জ।

উপস্থাপনাগুলি (Installation) ভঙ্গুর এবং ক্ষণস্থায়ী, তবু শিল্প সময়কে ছাপিয়ে যায়। উপাদানগুলির সমন্বয়ের মাধ্যমে নির্মিত হয় এক কাল্পনিক ও একইসঙ্গে দৃশ্যমান জগৎ। এই অস্থায়ী শৈল্পিক ক্রিয়ার কিছুই স্থির নয়। উপাদান এবং তাদের সম্পর্ক ইচ্ছাকৃতভাবে এলোমেলো। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য, কাজের ধারণা অপ্রত্যাশিতভাবে উদ্ভুত হয়। স্থান, সময় ও দর্শকের মিলিত প্রয়াসে গড়ে ওঠে শিল্প – আর সেখানেই আমার কাজের সার্থকতা

 

 

 

প্রসঙ্গত

শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়

 

গত দুই বা তার বেশি দশক জুড়ে আমার দাদা, দেবেশ, এই কোমল ও কঠিনের সহাবস্থানে তার শিল্পনির্মাণ ও ভাবনার নানাবিধ প্রকাশ করে চলেছে। ভারতবর্ষের নানান মন্দিরে এই কোমল-কঠিনের সহাবস্থান এবং প্রতিদিন তার জৈবিক পুনরুদ্ধার এই শিল্পভাবনাকে প্রথম উসকে দেয় সেকথা দেবেশ তার লেখায় ইতিমধ্যেই বলেছে। দীর্ঘদিন এই শিল্পের দর্শক হিসেবে এর অভিঘাত আমাকে আশ্চর্য করেছে এবং বাস্তব-অবাস্তবের সীমানা একাকার করা একরকমের বোধ-এর জন্ম দিয়েছে। এবং এই শিল্পবস্তু যখন চোখের সামনে নেই অথচ বাস্তবে এমন বহু সহাবস্থান আপনা থেকেই রয়েছে বা অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় (শিল্পসৃষ্টির তাগিদ থেকে নয়) সৃষ্টি হয়েছে তখন সেই বোধের অনুভব শিল্পীর প্রত্যক্ষ সজ্ঞান হস্তক্ষেপ ছাড়াই আপনা থেকেই প্রকাশিত হতে দেখেছি

গত বছরের মাঝামাঝি এমন কয়েকটি শিল্পবস্তুর বহমানতার সঙ্গে রচিত কবিতা লেখার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। কবিতার টুকরোগুলি কোনো অর্থেই ছবিটির শব্দরূপ নয় বরং একটি সম্পুরক রচনা। বহুশিল্পবাদ প্রসঙ্গে একটি ভাবনা প্রকাশ করা হয়েছিল এইভাবে যে সেই পাঠবস্তুতে নানা শিল্পের সম্ভরণ সরাসরি, প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ বা দার্শনিক প্রেক্ষাপটে থাকবে। সবটা মিলিয়ে একটি শিল্পবস্তু গড়ে উঠবে, যা একটি পাঠবস্তুর চেহারা নেবে। তার সমগ্রটা নিয়েই তাকে কবিতা বলা যেতে পারে, এক্ষেত্রে তার নাম দেয়া যাক ‘স্থাপনকলা-কবিতা।

 

প্রতিটি ছবির নীচে ছবিটি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া রইল।


 

©Debesh Goswami, 2014: I am what I am, artificial flowers, statue 200x 160x120 cm. University of applied Arts, Vienna, Austria.

 

আরশির বিভ্রমের চেয়ে ঢের বেশি

আরও কিছু কুয়াশা ছড়িয়েছে বনে

দীর্ঘ কান্ডের পাকে পাকে জড়িয়ে কোমল

শ্বদন্ত চাপা, পচা পাতার নীচে অপেক্ষায়

স্তব্ধতার ভেতর রুগ্ণ দিনের ছবি আঁকে যারা

তাদের খুঁজেছি আশেপাশে,

কেউ নেই। শূন্যতা শুধু জিয়োনোর কথা বলে!


 

©Debesh Goswami, 2010: I am what I am, flowers, statue with marygold flowers, 1280 cm. Birla Academy of Arts, Kolkata, India.

 

 

কায়োৎসর্গের দিনে অরণ্যের কথা মনে পড়েছিল,

দক্ষিণের ভূমি ছুঁয়ে উঠে দাঁড়াতেই প্লাবন এল

ধারালো তলোয়ারের পাশে জ্বলে উঠল আলো

যতদূর চোখ যায়, তোমার দৃষ্টির সীমায়

বিস্তৃত গ্রাম গঞ্জ শহর নগর ও কলতান

 

নিশ্চিত নিশ্চিহ্ন হবে বলে অপেক্ষায় থাকে অনন্তকাল


 

©Debesh Goswami, 2010: Statue de Marianne, flowers, 350x 120x125 cm. artificial flowers, Espace Ferdinand Brunot, Paris municipality, France.

 

আমিও ভেবেছি তুমি নেই

শহরের মানুষের মতো, অল্প হেসে

উড়িয়েছি চুল হাওয়ায় হাওয়ায়।

সুঘ্রাণের নীচে চাপা পড়ে থাকে তোমার বিবর্ণ চিঠিরা।

পরি আসে পরি যায়, ঋতু, বিষণ্ণ সন্ধ্যারা।

তারপর এইমতো কিছু কবিতার জন্ম হয়।


 

©Debesh Goswami , 2017: I am what I am, flowers, 290x90x80 cm. artificial flowers,statue, Parc Montsouris, Paris, France

 

অনাবৃষ্টির দিনে ঋতুমতী হবার কথা ছিল বুঝি!

শহরের নবীন জীবনের ভেতর উল্লাসের পাশেও

ঝকঝক করছে তোমার চোখ

দু-গলি পাশে যে পরবাসী ছেলেটি ছিল, আজ তার ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর দিন

 

ক্ষয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে এক সুতো লেগে

টিকে আছে কোনোমতে

গ্রহণের দিনে ঢেউ এসে পড়ে আচমকা...


 

© Debesh Goswami, 2016: journey, (insitu) Dimensions variable, Flowers, string, place de Garenne, Paris, France.

 

 

অথচ বিভ্রম ঢেকে রেখেছে সীমানা

কাঁটাতার, সেনাদল, পরিখা সবই যেখানে যেমন থাকার...

আমি সহজ মখমল দিয়ে ঢেকে দিতে দিতে ভাবি পর্ণমোচী গাছেরাও কি আসলে বিভ্রম!

প্রার্থনার আগে সবসময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে নিষ্ঠুর স্মৃতি।

আমাদের গ্রন্থভর্তি পোড়া ছাই

তবে যে বলো অক্ষরের মৃত্যু নেই, সেবেলা?


 

 

©Debesh Goswami, 2015: After the game, Dimensions variable, Gallery Grand E'terna, Paris, artificial flowers, fiberglass,tissue.

 

 

এই তো ক্রীড়াভূমি, এই তো স্বপ্নকাঁটা

বাই জোভ! সত্যি বললে?

নাকি সুরের তালে তালে মাথা দোলাতে দোলাতে

ভুলেই গেছ, বাইরেটা কীরকম দেখতে!

বিবর্ণ আকাশের পাশে একফোঁটা মেঘ,

ঝুলন্ত সেতুর পাশে চিরায়ত আলপনা।

 

কৃপনতা ছেড়ে এসো,

দু-দান খেলে নেওয়া যাক।

তারপর জলসার ঘোরে তুমি আমি কে কোথায়!


 

©Debesh Goswami, 2013: Meeting, 4500x 45x 50 cm. Garden of the Notre-Dame de la Souhaitier chapel, Garden of the Town Hall, Plouër-sur-Rance, France,

 

 

তোমাদের বলিনি কোনো নির্জন, বলিনি পরবাস, বলিনি একাকীত্ব

চিঠি লিখে জানতে চাইনি পুরোনো গহ্বরের কথা, চুন সুড়কির দেয়াল

অবহেলা কোনো নতুন শব্দ নয়,

নির্জনের পাশাপাশিই থাকে সে

শুধু চুপ করে দেখে কে কে এলো,

কে তার পত্রপুষ্পহীন ডালে মেখলা পরাতে চায়।

 

প্রাচীন মেঘেদের কাছে কিছু কথা জমা থাকে বুঝি!


 

©Debesh Goswami, 2021: Spring, concrete status, metal, artificial flowers,

260 x300 x 300 cm Zuzeum Art Centre, Riga,Latvia.

 

 

মোহ জুড়ে থাকে চারপাশ

বিষণ্ণতার দেবী, ভরনের কলসে বেঁধেছে তার স্মৃতি।

জলপ্রপাত দেখিনি এতল্লাটে,

যুদ্ধের পর কাঁটাতার ছিঁড়ে যারা পেরিয়ে গিয়েছিল মাঠঘাট

তারাই দুহাত ভরে এনেছে ফুলের সাজ প্রেমের অভিলাষ

 

চারপাশ জুড়ে তবু থাকে মোহ, অভ্রের কুচির মতো

বিরহ মধুর হল ওই!

 

 

শিল্পী পরিচিতি

দেবেশ গোস্বামী জন্ম ১৯৬৫। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিস্যুয়াল আর্টস-এর স্নাতক। ১৯৯৫ সালে ফ্রান্সে যান এবং ফরাসি সরকারের স্কলারশিপ পেয়ে রেনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং গবেষণা। ২০০২ সাল থেকে পাকাপাকিভাবে প্যারিসের বাসীন্দা। শিক্ষকতার পাশাপাশি শিল্পী হিসেবে একক ও যৌথ প্রদর্শনী হয় ইতালি, জার্মানি, পোল্যান্ড, রাশিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেনসহ ইউরোপের নানা দেশে। দেবেশের শিল্পকৃতি প্রদর্শিত হয়েছে আমেরিকা, জাপান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ভারতসহ এশিয়ার বহু দেশে। শিল্পমহলে সেগুলি ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সমাদৃত। ইন্টারন্যাশনাল আর্টিস্ট রেসিডেন্স হিসেবে ফ্রান্স, পোল্যান্ড, হল্যান্ড, ইউ এস এ ইত্যাদি দেশে কাজ করেছেন। কাজের বিষয় মূলত ভাষ্কর্য হলেও, ইন্সটলেশন ও মিশ্রশিল্প সৃষ্টিতে উৎসাহী। বর্তমানে ফ্রান্সের প্যারিসে তার ৩০ বছরের কাজের রেট্রোস্পেকটিভ প্রদর্শনীর কাজ চলছে। এই প্রদর্শনী হবে নভেম্বর ২০২৫ সালে।

 

 

 

 

 

কবি পরিচিতি

শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় – জন্ম কলকাতা ১৯৬৯। শিক্ষায় ভূতত্বে স্নাতকোত্তর। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় লেখালেখি শুরু; দীর্ঘদিন কবিতা পাক্ষিক পত্রিকার প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই যুক্ত। বহুদিন এই পত্রিকার সম্পাদনাও করেছেন। পরীক্ষা ও প্রকল্পভিত্তিক কবিতার প্রায় সবটাই কৌরব এবং কবিতা পাক্ষিকেই প্রকাশিত। কাব্যগ্রন্থ তিনটি, ছায়াপথ (১৯৯৫) অসমাপ্ত নিবেদিতা (১৯৯৯) এবং মানচিত্রের সন্ধানে (২০২০)। কবিতার পাশাপাশি ভ্রমণ-গদ্য, গল্প, এবং অনুবাদ সাহিত্যে বহু কাজ করেছেন। উল্লেখযোগ্য বই পাহাড়ি গ্রামের গল্প (২০১৭), বনভ্রমণ মনভ্রমণ (২০২১) দীন মহম্মদের ভারতভ্রমণ (২০১৯), কাপ্তান সুরেশ (২০২২)। বর্তমানে জয়ঢাক প্রকাশন-এর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত।