শুভ্ররূপ
মুখোপাধ্যায়ের
গদ্য
শুভ্ররূপ
মুখোপাধ্যায় বিশ
বছরের কারিগরির
ছাত্র। এর মধ্যেই
সে লেখালিখি, চিত্রশিল্প,
চলচ্চিত্র নির্মান,
ইত্যাদির প্রতি
আকৃষ্ট, নাট্যশিল্পে
প্রবল আগ্রহী;
হাতে খড়িও হয়ে
গেছে একাধিকভাবে।
নিয়মিত ছোট ছবি
ও নতুন ধারার নাটক
করছে বিশ্ববিদ্যালয়
স্তরে।
মাননীয়া মার্মালেইড্
-"Andy, তোমার কাজে ভাবনার
জায়গাটা আরো বাড়াতে
হবে। এ এক পরিবর্তনের
সময়। মানুষ সন্ধান
করে বেড়াচ্ছে
অবচেতনকে। দালি
বা মদ্রিয়ানকেই
ধরে নাও; তাদের
কাজে কত বিশদ, গভীর
চিন্তাশীল। দেশ
বিদেশ ভ্রমণ ক’রে,
সমমনস্ক ব্যাক্তিদের
সাথে সাক্ষাৎ করে
একে অপরের থেকে
কত কী শিখছে, জানছে।
আর তুমি কী করছ?"
- " তুমি কি চাও
বলো তো, Anna? এমন এক আলোকিত
সন্ধ্যায়, কাশিং
এ বসে, আনন্দে বেগেলটা
খাচ্ছি; খেতে দাও।’
- "বা দিয়েগো
রিভেরার কথা ভাব।
সে তো জয় করে নিল
শিল্পায়নের সমস্তটাকে,
হলের চার খানা
দেওয়াল জুড়ে
চিত্রিত করে।’
- "থামো থামো।
একি! তুমি ফ্রিদাকে
ছেড়ে রিভেরার
কথা তুলছ? ফ্রিদার
প্রকাশ তো অনেকটাই
অবহেলিত ও অবদমিত
ছিল তার স্বামীর
ছত্রছায়ায়।
আর এখন তো ফেমিনিস্ম্-এর
যুগ!’
- "আমি তাকেই
জেতাব যে আমার
চোখকে আরো ভালো
ছবি দেখার সুখ
দেবে। যোগ্যতমই
জিতবে টিকে থাকার
লড়াইয়ে।’
এ কথাটা
সে নিজের স্থির
বিশ্বাসে দৃপ্ততা
মিশিয়ে বলল। সে,
আনা ওল্সন। আমার
বছর পঞ্চাশের অবিবাহিতা
বন্ধু, যে গ্রাহ্যই
করে না তার পোলিও-ব’লে-ভুল-রোগ
নির্ণয়-করা অসাড়
নিম্নাঙ্গ কে।
সে চায়না তার অক্ষমতা
তার পরিচয় হোক।
সে ঘৃণা করে দয়া
আর করুণাকে। আমার
সচেতনতাকে ক্ষুরধার
বুদ্ধি ও মনন নিয়ে
আক্রমণ ক’রে ছিঁড়েখুঁড়ে
দেওয়াতেই যার সমস্ত
আনন্দ।
কাঁশিং-এ এসে
থেকেই এই ওল্সন
ভাই-বোন আমার বেশ
ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে
গেছে। ওদের ক্ষেতের
ঠিক উল্টোদিকে
একটা আরামদায়ক
জায়গা আছে যেখান
থেকে ওদের কঠিন
রুক্ষ বড় বাড়ি
ও খামার চোখে পড়ে।
হতবাক হতাম বাড়িটার
ছায়ান্ধকর দেখে।
একটা কোন অংশও
কি আকর্ষণীয় হতে
নেই! হয়তো,
সেজন্যেই ওর চারপাশের
দৃশ্যটা আরো মনোরম
হতে উঠেছিল।
- "সত্যি বলতে
কি, Wyeth, তুমি
গড়িমসি করছ।’
- "ওয়েল, আমি
কিন্তু যথেষ্ট
অর্থ রোজগার করেছি
১৯৩৭- এ আমার প্রথম
প্রদর্শনী থেকে
। তা ছাড়া বেটসিও
তো চাকরী করে।’
- "দেখেছো, এটাই
তোমার সমস্যা,
বড়ো বেশি অবসন্ন,
অননুপ্রানিত তুমি।"
- " সেটা কি খুব
খারাপ?’
- "যদি স্বচ্ছন্দ,
শান্তির জীবন চেয়েছিলে
তাহলে কারখানার
ম্যানেজার বা ইঞ্জিনিয়ার
হলেই পারতে। যাক,
আর তোমার পিছনে
নষ্ট করার মত সময়
আমার নেই। আমাকে
জন- এর মার্মালেইড্
বানাতে হবে। ক্ষেত
ভরে গেছে ব্লুবেরিতে।’
- আমি দুঃখিত,
যে শিল্পকে আমি
জটিল করে তুলতে
পারিনা। এটা চল্লিশের
দশকের শেষ অংশ।
যুদ্ধ ও থেমে গেছে।
মানুষ এখন সহজ,
সংহত জীবন চায়।
এর মধ্যে expressionism- এর ধূসরতা,
cubism- এর
উত্থান, দালি ও
অন্যান্যরা আনছে
আনুক, আমি পারবনা।
প্রকৃতি, মানুষ,
তাদের সরল জীবন
আমায় টানে। যেমন
Frost বাসা
বেঁধেছিলেন নিসর্গের
রূপে। খ্যাতি ও
তো পেয়েছিলেন।
আমি চাই আমার কাজ
এত বাস্তব হোক,
ঠিক যেমন আমরা
চোখে দেখি। আর
তা যদি "অননুপ্রাণিত’
হয় - তাই হোক।
Maine তার আর্দ্রতা
নিয়েও বড়ো সুন্দর।
আমার প্রতিটি সন্ধ্যা
ভ্রমণ সে নোনা
জোলো হাওয়ায় ভরিয়ে
দেয়। Maine কে আমি ভালোবেসে
ফেলেছি। যদিও Chadds Ford এ নিজের বাড়ির
জন্য মন কেমন করে
খুবই । মাঝেমাঝে
মনে হয় এই কাসিং-
এ আমি বেশি স্বচ্ছন্দ,
মূলত ওল্সনদের
জন্যই, ওরা আমাকে
মনে পড়ায় Chadds Ford - এর Kuerners দের কথা। বহু
বছর ধরে আমার শিল্পভাবনার
মধ্যেই এই দুই
পরিবার জড়িয়ে
আছে। বিশেষত বাবা
মারা যাওয়ার পর
থেকে।
- "এই ছবিটির
জন্ম দুর্ঘটনার
পরে। সবাই বলে
এখানে ছেলেটি আমি।
তবে আমি নিজে অত
নিশ্চিত নই। ছবিতে
পাহাড়টা দেখছো?
দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল
তার অপর পারে।
বাবার ইচ্ছা ছিল
আমি তাঁর পোর্ট্রেট
আঁকি - তা যে হয়ে
ওঠেনি সে আক্ষেপ
আমার থেকে যাবে।’
N.C. Wyeth – এক বিখ্যাত
ভিসুয়াল আর্টিস্ট,
স্নেহময় পিতা।
- "এই পাহাড়টা
আমার বাবা। ভাবছিলাম
নাম রাখব, ‘দা সাডেন্
উইন্টার্ অফ্ ১৯৪৬'।’
"না। নামটিকে
সহজ আর গম্ভীর
করো। ‘উইন্টার
১৯৪৬'।’
মাঝেমধ্যেই
আনা খুব অন্যমনস্ক,
উদাসীন - যা আমার
বিরক্তির কারণ
হয়ে দাঁড়ায়। তবে
এ সত্বেও আমি ওর
সাথে এক আত্মিক
যোগাযোগ অনুভব
করি। মনে হয় যেন
আমি ওকে অনন্তকাল
চিনি। ও আমার সবথেকে
নির্ভরযোগ্য ও
বিশ্বাসের পাত্রী।
সেই প্রধান ও প্রথম
যার কাছে আমার
শিল্পসৃষ্টি স্বীকৃত
এবং সমালোচিত,
ও। সত্যি বলতে
কি, শিল্পী হিসেবে
আমাকে কোন জীবনসংগ্রাম
করতে হয়নি। সেই জন্যই হয়
তো আমার কোন নতুন
পেন্টিং-এর উপর
তার অঙ্গুলিপ্রদর্শন
বা সমালোচনা আমি
সঠিক ভাবে গ্রহণ
করতে পারতাম না।
- " প্রকৃতির
থেকে ধার করে শখানেক
বর্ণ তুমি মেশাতে
পারো তোমার রঙে-
যেমন ধরো চন্দনকাঠের
বর্ণ বা ব্লুবেরীর
নীলাভ। কিন্তু
কেন এই কুসুম- হলুদ?’
-"আনা, Tempera করতে একটা
শক্ত ভিত লাগে।
Pollock যেমন
তার drip পদ্ধতির
জন্য খ্যাত, Seurat যেমন Pointillism এর জন্য, আমিও
এর মধ্যে দিয়েই
পরিচিত হতে চাই।’
- "মাঝেমাঝে
তোমায় শিশু মনে
হয়, অ্যান্ডি।
হা ঈশ্বর, এটা কী?!’
ব্যাস, আমার
ধৈর্যচ্যুতি ঘটল।
আমার সদ্যোজাত
সৃষ্টির প্রতি
একটি সদর্থ বাক্য
শুনতে চাওয়া কি
খুব অপরাধ? তারপরের
কয়েকদিন আনার সাথে
বন্ধ আমার কথা।
ঠিক এই সময়ই ওর
ভাই জন্ অসুস্থ
হয়ে পড়ে। সে সময়
গোটা রাজ্য প্লেগের
গ্রাসে, জন্-এর
মতই। এগারো দিনের
মাথায় জন্ সুস্থ
হয়ে উঠবে কিন্তু
একদিন মনে হল সে
জীবনের শেষতম পর্যায়ে
এসে দাঁড়িয়েছে।
আনা তার নিজের
অপারগতা, অক্ষমতার
কথা এক মুহুর্ত
ভুলতো না। জন- ই
ছিল তার একমাত্র।
সমস্ত। যে অনুভূতি
সে তার কঠিন আবরণের
আড়ালে লুকিয়ে
রাখত, হৃদয়তন্ত্রীর
সে তার জন-ই শুধু
পারত বাজাতে। তাই
সেদিন ভোরে উঠে
তার মনে হল সব শেষ
হয়ে যাওয়ার আগে
একটা কাজ তাকে
করতেই হবে। সে
ক্ষেতের দিকে এগোল
তার অসাড় শরীরটি
মাটিতে ঘষে ঘষে
- যেমন ভাবে সে বাড়িতেও
কাজ করে। আমি শুনতে
পেয়েছিলাম এক দূরতর
ডাক 'Wyeth! Wyeth!' তবুও নিজেকে বোঝালাম
যে ও তো উড়ে যাওয়া
দূরগামী পাখির
রব।
মাত্র দুজন
ছিল তার জীবনে
যাদের সে ‘আনা' বলে
ডাকার অনুমতি দিয়েছিল।
তার মধ্যে একজন
মৃত্যুশয্যায়।
বাকিদের কাছে তার
পরিচয় ছিল ক্রিস্টিনা
নামে। অভিজাত ক্রিস্টিনা,
বাড়ির সর্বময়ী
কর্ত্রী। ক্রিস্টিনা
- তার অনায়াস , আটপৌরে,
অসহায় রুপটির কপাট
বন্ধ করে বাইরের
সমাজে সে তীব্র,
দীপ্ত।
ছোট একটা ঘুমের
পর, কাঠের জানালার
শার্সি যখন খুলে
দিলাম শেষ বিকেলের
হলুদ আলোর বৃষ্টিতে
বাইরের যে অপার্থিব
দৃশ্য আমি দেখলাম
তা আমার সমস্ত
মন মথিত করে গেল।
বিমূঢ় হয়ে গেলাম।
তখনো জানতাম না।
সেই দৃশ্য আমার
মননে ও ক্যান্ভাসে
একই ভাবে আঁকা
থাকবে।
মাঠের মধ্যে
দিয়ে ক্রিস্টিনা
এগিয়ে যাচ্ছিল
তার পা দুটিকে
টেনে টেনে। এর
মধ্যে সে অজস্র
ব্লুবেরী জোগাড়
করে ফেলেছে। মুখে
দৃঢ়তার ছাপ আর
অন্তর - লৌহ কঠিন।
ভাই কে হারানোর
আগে কথা রাখতেই
হবে - তাকে খাওয়াতেই
হবে মায়ের কাছে
শেখা ব্লুবেরী
মার্মালেইড।
যখন শরীরের
হাড়গুলো বাদ সাধল,
তখন সে এগিয়ে
চলল মনের জোরে।
সে সন্ধ্যা ওল্সনগৃহ
ভরে থাকল ব্লুবেরীর
অপূর্ব সুবাসে।
জন্ ফিরে পেল তার
জীবন। আর আমি অনুপ্রেরণা।
'Christina's
World' রূপ পেল।
তুলির শেষ টানের
পর যখন ছবিটি তাকে
দেখালাম, সেই প্রথমবার
তার চোখদুটি কে
মুখর হতে দেখেছিলাম
নোনা জলে আর হাসিতে।
এখনো অবশ্য সে
ব্যাঙ্গ করে বলে
যে তাকে সাহায্য
করার চেয়ে বাজারে
ডিম কিনতে যেতে
আমি বেশী ব্যাগ্র
ছিলাম।
"বিশ্বাস ছিল
তোমার ওপর। তাছাড়া
তুমি তো বকতে আমায়
অভ্যাসবশত, সাহায্য
করতে গেলে।’
"সেটা মজার
চোটে। আমাকে পা
দুটো ধার দেওয়ার
বদলে তুমি ছুটলে
এক পঙ্গু মহিলাকে
আঁকতে! হাহাহা।"
যতদিন গেছে
আনা ক্রিস্টিনা
ওল্সন্ এর প্রতি
ভালোবাসা আরো বেড়েছে
আমার । আমার স্থির
বিশ্বাস যেদিন
মাটির পৃথিবীর
কাছে ফিরে যাবার
দিন সমাগত হবে।
পরম শান্তিতে,
নিশ্চিন্তে আমি
ছেড়ে আসবো 'Christina's
World', 'Winter 1946' ও বাকি
সব যা যা Andrew Wyeth এর নামে পরিচিতি
পাবে। আর তারপর
আনার হাত ধরে Maine- এর সোনালি
দিনের স্মৃতির
উষ্ণতায় ভরে যাব
আমরা।
ইংরেজী থেকে
অনুবাদঃ দেবশ্রুতি
মুখোপাধ্যায়
মূল রচনাঃ
Of Marmalade, In Maine
Copyright ©
2020 Subhrorup Mukherjee Published 1st Sep, 2020.