গল্পঃ জয়শীলা গুহ বাগচী 

 

কবি জয়শীলা গুহ বাগচী অত্যন্ত সুপরিচিতা। প্রায় আঠারো বছর কবিতা চর্চার পর সম্প্রতি গল্পের জগতে নতুন পদার্পণ।  উত্তর বঙ্গের জলপাইগুড়ি শহরে জন্ম বেড়ে ওঠা। পেশা শিক্ষকতা। এ পর্যন্ত দুটি কবিতার বই ও একটি কবিতাপুস্তিকা।প্রিয় রঙ জলপাই।

image003

 

 

লকডাউন

 

                                           

ঠিক ছাদের দিকে তাক করে ছুড়ল পেনটা। ওই যে জায়গাটা সামান্য খুবলে আছে, সেই পয়েন্টে। নাহ এবারও হল না । একটু বাম দিক ঘেঁষে লেগেছে। কেন হচ্ছে না? হতেই হবে। নিজের শুয়ে থাকার অবস্থানটা একটু বদলে ফেলল নয়ন। পূর্ব পশ্চিম করে শুয়ে ছিল সে, এবার শুল উত্তর দক্ষিণে। এবার ছুড়বে পেনটা। লাগতেই হবে এবার। সেদিন যে কলমটা উড়ে এসেছিল ওর দিকে, সেটা খুব আকস্মিক ছিল বলে ওটা নয়ন ক্যাচ ধরতে পারেনি। এবার লক্ষ্য আর ক্যাচ কোনটাই মিস হবে না তার। কনসেনট্রেট করল সে, অর্জুনের মতো কী দেখছে এবার? ছাদের খোবলানো জায়গা। শুয়ে শুয়ে লম্বা শ্বাস নিল  নয়ন। বিছানা থেকে একটু উপরে উঠল যেন তার শরীর, আরও লম্বা শ্বাস নিল সে, আরো একটু যেন উঠে গেল বিছানা থেকে। ছুড়ল পেনটা, অল্প ঘুরে উঠে যাচ্ছে পেনটা । নয়ন ঘটনাটা স্লো মোশনে দেখতে চাইল। পেনটা মাধ্যাকর্ষণ অস্বীকার করে উঠে যাচ্ছে। এবার ব্যাপারটা পজ করতে হবে। লক্ষ্য পর্যন্ত ঠিকঠাক যাবে কিনা দেখতে হবে । এটার একটা মেজারমেন্ট আছে, সেইটা না মাপতে পারলে ভুল হয়ে যেতে পারে। নয়ন আরও লম্বা শ্বাস নিল, উঠে এল পেনের কাছাকাছি, পেনটাকে ও টাচ করবে না। শুধু চোখের মাপেই ও বুঝে যায়, যেন একটা কমপিউটারাইজড মেজারমেন্ট সিস্টেম বসানো আছে ওর চোখে। কিন্তু মনে হল একটু ভুল আছে। সামান্য একচুল ভুলের জন্য এবারও ... । কি করা যায় ভাবছিল নয়ন, পাশের ঘর থেকে বাচ্চাটা খুব জোরে কেঁদে উঠল। চেঁচিয়ে উঠল সোমা,

 

-         তুই কি এক মুহূর্ত শান্তি দিবি না? তোরা কেউ আমাকে এক মুহূর্ত শান্তি দিবি না? সারাদিন বসতে

          পর্যন্ত পারি না।

-    ও মেয়ে, খেতে তো দাও বাচ্চাটাকে । আমি কতক্ষণ ভুলিয়ে রাখবো।

-    কতটুকু সময় তুমি রেখেছো? হাতের কাজটা তো শেষ করতে দেবে? সারাক্ষণ শুধু ডাকাডাকি।

-    তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলবে না। বড্ড বেশি সাহস। সহবত শিক্ষাও কি নেই?

-    ছিল তো। এ বাড়িতে এসে সব ভুলে গেছি।

-    আমি উঠতে পারি না বলে যা খুশি তাই বলবে? 

 

ধরাম করে দরজা খুলে গেল। ছেলে কোলে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সোমা। নয়নের দিকে তাকাল, অত্যন্ত বিরক্তিতে তেতো হয়ে আছে তার মুখ।  নয়ন নামলো না ওপর থেকে। ও জানে সোমা কি বলবে ওকে।

 

-        বাজার কি আজকেও হবে না? লকডাউন বলে কি পেটও বন্ধ? কতদিন আলুসেদ্ধ চলবে?

-        যাচ্ছি।

-        যদি কিনতে না পারো ত্রাণের জিনিস তো আনতে পারো।

-        আমাদের কেউ ত্রাণ দেয় না।

 

গম্ভীর গলায় উত্তর দিল নয়ন। উঠে দাঁড়ালো। এবারও লক্ষ্যভেদ হয়নি। অথচ কিছুদিন আগেই বসের পেনটা অন্যদিনের মতোই তার দিকে ধেয়ে এসেছিল, একটুও মিস হয়নি। বিরক্তিতে রাগে সামান্য হাতের টোকায় যে খেল তিনি দেখালেন তা সত্যি নয়নকে আশ্চর্য করেছে। পেনটা টেবিল থেকে একটু লাফিয়ে উঠে কয়েকটা ডিগবাজি খেয়ে তার দিকে এগিয়ে আসতেই সে ক্যাচ নিতে গেল, কিন্তু সেদিন কেমন ঘাবড়ে গিয়ে সে পারেনি এবং কোনদিনই পারে না। পেনটা তার পেটে এসে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল নীচে। সেটা তুলে বসকে দিতে গিয়ে সে দেখেছিল বসের মুখে একটা হিংস্র হাসি। এই পেন ছোড়াটা আগেও কতবার হয়েছে । বস বললেন, এবারের টার্গেটও সে নাকি ফুলফিল করতে পারেনি। সে কিছুই করেনি তা তো নয়। কিন্তু তাতে নাকি হবে না। নয়ন নাকি পারছে না। বেসরকারি বিমা কোম্পানিতে উন্নতি করতে হলে বলিয়ে কইয়ে হতে হয়। নয়ন বলতে পারে কিন্তু কইতে পারে না। বস বলেন ওই কইতে পারার মধ্যেই নাকি আসল চাবিকাঠি।  নয়নকে তৈরি করার জন্য বস অনেক চেষ্টা করেছেন। হাল ছেড়ে পেনটাই ছুড়তেন। প্রতিবার ক্যাচ মিস হয়ে যেত নয়নের। কিছুদিন হল পেন ছোড়া আর ধরাতেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে নয়ন। এটা তাকে পারতে হবে, সেজন্য অনেকরকম প্রস্তুতি তার। আজকাল সব জায়গাতেই সে নিশানা ঠিক করে । তার প্রায় শয্যাশায়ী মা যখন বার বার এক সুরে ডাকতে থাকে, সে তখন মার মুখে পেনটা গেঁথে দেবার কথা ভাবে। সেই ছোড়াটাও একটা বিরাট চিন্তার ব্যাপার মনে হয় তার। কতটা মেজারমেন্ট, কতটা স্পিড সে হিসেব করে মনে মনে। আর ভাবে বস হলে ঠিক পেরে যেত একবারে।  বাজারে যেতে হবে নয়নকে। কয়েকদিন এদিক ওদিক করে কাটিয়ে দিয়েছে। আজ আর ছাড় নেই। বাড়িতে কত বোঝাবার চেষ্টা করে যে লকডাউনে আলু আর ভাতই যথেষ্ট। সে পারছে না বোঝাতে। ওই কইয়ে হতে পারেনি কোনদিন। তার কথা কেউ শোনেও না, মানেও না। একদিন মানতে তো হবেই, যেদিন পেনটা...। টারমিনেশন লেটারটা হাতে ধরিয়ে বসের মুখটা একটু করুণ হয়েছিল।মাস্কের ওপর দিয়েও বোঝা যাচ্ছিল সেটা। নয়নের কেমন যেন গুলিয়ে উঠেছিল গা টা, মাথা ঘুরছিল। সামনে চেয়ারটা ধরে ফেলেছিল। বস তার একটু কাছে এসে  বলেছিল,

 

-        পারলাম না বাঁচাতে। এর আগেও বাঁচিয়েছি। এবার  তো জানোই ইকোনমির অবস্থা।

          কোম্পানি হালকা হতে চায় বুঝলে। শুধু তোমার নয় সারা দেশে, গোটা পৃথিবীতে কত মানুষের চাকরি চলে           যাচ্ছে, জানো তো? আরে আমেরিকার অবস্থা দেখেছো? জবলেস জবলেস...

-        স্যার, আমি কিন্তু প্র্যাকটিস করছিলাম। আমি কিন্তু করছিলাম...

 

বিড়বিড় করতে করতে নয়ন বেরিয়ে আসে অফিস থেকে।

 

-        তুমি কিন্তু প্র্যাকটিস ছেড়ো না।

 

 চেঁচিয়ে বলেন বস। আর পেছন ঘোরে না নয়ন। পকেটে পেনটা চেপে ধরে। হ্যাঁ প্র্যাকটিস তাকে চালাতেই হবে। বাড়িতে বলবে কী করে?  প্র্যাকটিস তো চালাতেই হবে। একদিন ঠিক পেনটা লুফে নিতে পারবে। জায়গা মতো লক্ষ্যভেদও সে পারবে। মেজারমেন্ট আর স্পিড, তার সাথে মেন্টাল স্টেট, মাংসপেশীর সঠিক ব্যবহার ইত্যাদি অনেক ব্যাপার সে জানে। এগুলো আয়ত্তে এলেই সে জানে হয়ে গেল তার স্বপ্নপুরণ। লকডাউনের পর থেকে বাজার সেভাবে আর বসে না। ভীড় বেশি হয় বলে পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে গেছে বাজার। রাস্তার ধারেই দুটো তিনটে করে সবজির দোকান বসেছে। বেশ দাম সবজির। টাকা যেটুকু রেখেছিল তা তুলে এনেছে ঘরে। খুব সামান্যই মাইনে ছিল তার। সংসার চালাতে গিয়ে কিছুই তেমন জমেনি। অল্প অল্প করে খরচ করছে সে। সোমা বোঝে না, মা বোঝে না। এটা কেনো, সেটা কেনো। রাগে গা জ্বলে যায় নয়নের। আরে সে তো বসে নেই, আর একচুল বাকি। তারপর বস তো আছেই। দেখিয়ে দেবে সে। কতটা পারফেক্ট মেজারমেণ্ট তার, স্পিড সম্পর্কে সে কতটা জানে। তাড়াহুড়োয় মাস্কটা পরতে ভুলে গেছে নয়ন। আজকাল এমন হয়েছে, মাস্ক না পরলে সবাই কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করে। পকেট থেকে রুমালটা বেঁধে নিল মুখে। সবজি কিনতে গিয়ে মাথা ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগলো নয়নের। এত দাম বেড়ে গেল কয়েকদিনে? ইয়ার্কি হচ্ছে। একটা দোকান ছেড়ে অন্য দোকান, না কোথাও দামে সুবিধে করতে পারল না সে। তার দরদাম করা দেখে সবজিওয়ালা কথা শোনাতে ছাড়ল না,

 

-          আমাদের সাথে দরদাম করেন দাদা, এখনি তো হরেক রান্না করে ফেসবুকে দেবেন। বসে বসে মায়না পান।       আমাদের সাথে দরদাম করেন?

-          এত দাম নিলে বলবো না? আর আমি কী রাঁধবো, কোথায় ছবি দেবো সেটা কি তোমার দেখার কথা? তুমি      তোমার কাজটা কি ঠিকমতো করছো?

   

আশেপাশের সবজিওয়ালাও বাঁকা কথা শুরু করল। এসব কটুক্তি মোটেও সহ্য করার মতো নয়। পায়ের নখ থেকে রাগটা ঘুরে ঘুরে উঠতে লাগল নয়নের। সে বুঝতে পারছিল কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে রাগটা উঠছে তার। কই এর আগে এমন করে রাগের চলাফেরা সে টের পায়নি তো। রাগ হলেও কেমন মিইয়ে থেকেছে। এবার সে চিৎকার করবে ভাবলো, নাকি মারামারি করবে। হঠাত কী মনে হল, পকেট থেকে মেটালের পেনটা বের করে, বসের ভঙ্গিতে ছুঁড়ল সবজিওয়ালার দিকে। টিপটা ছিল দুই ভুরুর মাঝে। পেনটা কয়েকটা ডিগবাজি খেয়ে সটান লাগল সবজিওয়ালার দুই ভুরুর মাঝে। কয়েক সেকেন্ড সবাই স্তব্ধ। সব্জীওয়ালার কপালে ফুটে উঠল রক্তচিহ্ন। আনন্দে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল নয়ন। পেরেছি পেরেছি ...চিৎকার করতে করতে দৌড়োতে লাগল নয়ন। পেছনে কয়েকজন বাজারের লোক। পাড়ার মোড় ক্রস করতে পারল না সে। ওরা ধরে ফেলল নয়নকে। এত মার কখনো খায়নি নয়ন। প্রত্যেকটা মার পরিতৃপ্তির সাথে গ্রহণ করছিল সে। পাড়ার দুতিনজন ছেলে না বাঁচালে হাসপাতালেই জ্ঞান আসতো নয়নের। জামা প্যান্ট ঝেরে উঠে দাঁড়ালো সে। বুক চিতিয়ে নোংরা রক্তমাখা মুখে এক চিলতে হাসি জ্বালিয়ে দিল। দৌড় লাগালো নয়ন। বসকে ফোন করতে হবে। সোমাকে দেখাতে হবে, সে পেরেছে। ছেলেরা কেমন হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নয়নের দিকে তাকিয়ে। নয়ন মোড় ঘুরে অদৃশ্য হল। বাড়ি পৌঁছে  চিৎকার করে ডাকল সোমাকে। ছেলে কোলে বেরিয়ে এল সোমা। এখনো সে রান্না চাপায়নি। বাজার আসবে, এই আশায় সে অপেক্ষা করছে আর শাশুড়ির সাথে ঝগড়া করছে। বেরিয়ে এসে দেখে নয়ন ধূলো মাখা, মুখের কষ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। খুব ভয় পেয়ে গেল সে। নয়ন ছুটে এল সোমার দিকে। ওকে ধরে জোরে জোরে বলতে লাগল, একটিই কথা, “আমি পেরেছি। দেখবে, তুমি দেখবে?” কিছু বোঝার আগেই সোমার কোল থেকে শিশুটিকে নিয়ে ছুঁড়ে দিল ওপরে। সোমা আর্তনাদ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল ধরার জন্য। চোখের নিমেষে বাচ্চা ও সোমা আছড়ে পড়ল মাটিতে। চিৎকার আর কান্নার মাঝে ছুটে এল লোকজন। রোগের ভয় উপেক্ষা করেই। হাসপাতালে নিয়ে গেল ওদের।

 

মা শুয়ে শুয়ে একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে। শূন্য উঠোনে রক্ত মাখামাখি ঠোঁটে বিড়বিড় করতে লাগল নয়ন।

 

- আমি তো পারতাম সোমা, আমি তো পেরেছি, আমি পেরেছি।

 

হঠাৎ তার মনে পড়ল বসকে তো জানাতে হবে। ছুটে গেল ঘরে, বালিশের তলা থেকে মোবাইল বের করে ডায়াল করল নম্বর, বসের ফোন রিং হচ্ছে, হয়েই যাচ্ছে, কেউ তুলছে না। আবার ডায়াল করল সে, আবার... পনেরো বার , কুড়ি বার...

    

Copyright © 2020                                 Joyshila Guha Bagchi                                Published 1st Sep, 2020.

image004

image005