ঋষি সৌরক
অরণ্যর কবিতা
জন্ম ১৯৯১,
বাড়ি বাঁকুড়া।
স্কুলজীবন কেটেছে
সেখানেই। বয়ঃসন্ধি
কেটেছে কানপু্রে
এবং কর্মজীবন আমেদাবাদ।
মূলত প্রথম দশকের
গোড়া থেকে লেখালেখি।
প্রথম কাব্যপুস্তিকা
“হোটেল কলকাতা”
এবং যৌথ গদ্যের
বই “ডুমস” (২০১৪)।
গল্পের বই “ফ্যাণ্টাশিহরণ”
(২০১৬)। লোকচক্ষু
এবং লেমন আলোর
বাইরে থাকা নতুন
লেখার খোঁজে থাকেন।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
থেকে গাছ চেনার
আগ্রহ পেয়েছেন।
প্রিয় রঙ জলপাই।
ফণিমনসার তোরণ
তরুণ কবি।
তোমাকে তোমার মত
হারিয়ে যাবার।
নষ্ট হবার। মায়াজাল
বুনবার। এবং ছেঁড়বার।
প্রশ্রয় দিতে পারিনি
আমরা।
তোমাকে পথ
দেখাবার মত আলো
আমাদের আছে। অথচ
তোমায় নিজের মত
নিজে পথ খুঁজতে
দেবার সাহস আমাদের
নেই।
বাংলা ভাষাকে
অপহরণ করে নিয়ে
যাবার এই পথ অনেকটা
অন্ধকারের মতন।
যেন কিছুই নেই।
যেন কতকিছুর গ্রাম।
তুমি সেই অন্ধকারে
ঝাঁপ দিয়ে ভাষাকে
মুক্ত করো। এই
যে অভয়ারণ্যের
আলোকিত স্বাধীনতা,
একে চিরতরে ফুঁ
দিয়ে নিভিয়ে। একটা
অনির্দিষ্ট অরণ্যে
বাঁধো পল্লীঘুমের
পিউকাহা।
সময়ের দূরত্ব
বাড়িয়ে কমিয়ে একদিন
ঠিক সেই গ্রামে
যাবো। শীর্ণনদীটির
পরিত্যক্ত সাঁকোর
ওপরে বাঁধবো মাচা।
কথোপকথন। এমন হেন
কিছুই হয়নি কথার
কথা। এবার হবে।
আমার সাথে তোমার
ভাষা। তোমার সাথে
আমার। আমরা সবাই
ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে
মেহগনি পাতায় লেগে
থাকা শেষ চড়ুইটুকু
মেখে নেব৷ আর কথা
হবে। উপকথায়। যেন
সত্যিই বাকী রয়ে
গেছে কত কী বলার।
হৃদয়ে নিয়মিত নিশিডাকের
স্তব। যা কিছু
পেরিয়ে। যা কিছু
এড়িয়ে। এত আবগারি
আয়োজন। অথচ ঘুম
আসে না।
কে যেন বারবার
কী যেন আশ্চর্য
জোছনা দেখাবে বলে...
ডেকে যায়, ঘুম থেকে
পরাবৃত্ত ঘুমে। শুধু
ঘুম নেই। আউস ধানের
বিষণ্ণতায়। দেখা
আর দেখা। এভাবেই
যেন অবিশ্রান্ত
বোবা দৃশ্যের ভেতর
আকণ্ঠ শিস। খুঁজে
পায়। বাড়তি শব্দের
খোসাগুলি। রোজ
রোজ পিঠে বয়ে।
সমস্ত নদীতে ভাসায়।
নিজেকে নষ্ট
করো। কী হলে কী
হতো - অ্যালগরিদম।
কার্যকারণ। বনসাইপ্রেমী
ভীতুদের কাছে।
সাধ ও সাধ্যের
কাব্য। মুলতুবি
রেখে। মৃত হরিণীর
পেছুটান। মৃত হরিণের
মত। ছোটা। দলছুট,
যাকিছু পরাধীন।
তা তোমার রক্তে
সয় না।
এই ভরসা তোমায়
আমরা দিতে পারিনি।
তাই ঐশ্বরিক ফাঁদ
ভুলে বারবার ঈশ্বর
প্রিয় হয়ে উঠেছে
যাদের... চাঁদ গেলে
দাও! তরল নেমে আসুক।
ঘন ঘন তৃষ্ণা মেটাক
শেষরাত্রের অপহরণ।
ভাষা যায় যাক
চুলোয়। অত সামলে
সুমলে কাজ নেই।
জংলা নদী থেকে
জিভ দিয়ে গলে পড়া
চাঁদ চেখে নিতে
শেখাও। পরিত্যক্ত
সাঁকোটি যখন আরোও
নিস্তব্ধ করে তুলবে
আমাদের।ভাষাটি।
জিরাফের মত উপমাবিহীন,
ধোঁয়া ছাড়বো... ফেলে
আসা পথে ফিরে যেতে
পারে না সকলে।
তরুণ কবি... আরেকবার
বোধিবৃক্ষের নিচে
দেখা হবে! আউস ধানের
ভাষায়।
নিঃসঙ্গতার
তামাম পাল্কিবাহক
তখন জাগরণের যাবতীয়
ক্লেদ রেখে। নিমগ্ন
বিশ্রামে লীন।
ঠিক দেখা হবে।
শতক অভিসার পর।
তোমায় যেন সেইটুকু
নিঃসঙ্গতা দিতে
পারি। দিতে পারি
জরুরি বিধ্বংসের
তুমুল নির্জনতা।
খুঁজতে খুঁজতে
যাকে এক। অপকেন্দ্র
কিশোর। খুঁজে নেবে
নিজেরই নিম্নগ্রামে।
শীর্ণনদীটি বুকের
গভীরে। কবে যেন
হারিয়ে গেছে। অথচ তার আলো আজো
ফিরে আসেনি। শুধু
তুমি আসবে বলে।
ফিরে।
বিচ্ছেদ
বিষহীন বাস্তুসাপের
মত ঘুরপাক খাওয়া
থোকা থোকা জোছনার
সিঁড়ি। অথচ ছাদ
বড় নিষিদ্ধ পরিহাস,
তাই, একমহলায় গৃহবন্দী
একমহলা। ফুলেল
স্কার্ট। কী ফুল।
কে জানে। তবে তার
চেতনার ভাষায় সে
হয়ে ওঠে, কুমুদ।
একটা হাল্কা মিঠে
আওয়াজ কানে এসে
বাজে। ফুলের ঘ্রাণ
ছড়ানোর স্বচ্ছন্দ
বাজনা। উৎকণ্ঠা
নেই। নেই নিষেধের
কালচে রুমাল। জৈষ্ঠ্যের
দ্বিপ্রহরে সারাটা
সময় চৌধুরীদের
পরিত্যক্ত বনসায়র
ও সংলগ্ন বাতাস
মাতাল হয়ে থাকে।
এ শুধু সৌরভ নয়,
এক স্বয়ংসম্পূর্ণ
সুবাসের নিভৃত
যাপন। তাতে মিশে
আছে স্বাধীনতার
বাঁকা মেঠো পথ।
বাঁশবাগানের নীচু
জলায় বসে থাকা
অদৃশ্য পাখিটির
রোধ। স্থানে স্থানে
অবারিত চোরকাঁটা।
সেই পথ বেয়ে আরো একটু
এগিয়ে গেলে লতাগুল্মের
অবগুণ্ঠনে সুপ্ত
এক নির্মেদ সায়র।
যেন কত স্নান বাকি
রয়ে গেছে। যেন
এই বিচ্ছেদ তার
নিরবিচ্ছিন্ন
অভিমানের বিকল্প
লয়। কুমুদখচিত
এইসব নির্বিকল্প
প্রণয় ছাদ হেতু
রচনা নিষিদ্ধ।
অথচ ছাদটিকে নিবিড়
অরণ্যের নির্লিপ্ত
সায়র ভেবে নিতে
কারো নিষেধ ছুঁতে
লাগে না।ছুঁতে
লাগে না একতলার
আধকানা ঘরটিকে
মুক্ত জোৎস্নায়
স্নানরত একরত্তি
প্রাগৈতিহাসিক
ছাদের অভিসারে
যেতে। একমহলা যায়
ছাদের কাছে, ছাদ
যায় অরণ্যে। যাওয়াই
সার। কেউ কারোরই
কাছে পৌঁছতে পারে
না। অপেক্ষায় অপেক্ষায়
দোল খায় একটি জলপাই
সাইকেল।
ততোধিক জলপাই
তার টুংটাং৷ চিঠি
আসে। ধুলো মিশে
থাকা অক্ষর। যুদ্ধমথিত
কোনও সৈনিক। যুদ্ধই
তার ধ্যান। যুদ্ধই
তার জ্ঞান। এবং
ডানহাতি। যাকিনা
গুরুতর জখম। প্রেমিকাকে
চিঠি লিখে দিচ্ছেন
সহকারী বন্ধু।
বন্ধুটি এ ভাষার
কেহ না। তবু তার
চেষ্টা এ চিঠিতে
এ ভাষাতে ছত্রে
ছত্রে বর্তমান।
সেই চিঠি ঘটনার
ঘূর্ণাবর্তে আছাড়ি
পিছাড়ি খেয়ে কলম্বাসের
মত পৌঁছায় ভুল
ঠিকানায়। অভিযান
নেশায় ভরপুর আমাদের
ভাষা। সদ্য
মালভূমি বয়ে আসা
কিশোরী। ভুল চিঠিদের
ভুল বানানে মরিয়া
জখম খুঁজে নেয়।
ভাষা বলতে। কেবলই
তার উৎসহারানো
জল। ল্যাটেরাইট
মাটি। শাল-পলাশের
শ্যামলা ছায়ায়
মেঘলা নৈবেদ্য'র
দেশ। নিরুদ্দেশ।
মুহুর্মুহু উড়ে আসা কাঠঠোকরার
পিয়ানো। মনের কথাগুলি
বয়ে বেড়ায় মল্লভূমের
নির্জন বাতাস।
শত সাবধানতা অবলম্বন
সত্ত্বেও লাল লাল
ধুলো ক্রমশ ঘনিয়ে
আসে। ধুলোয়
যেন কার রক্ত।
রক্তে বিচ্ছেদের
বারুদ। কিছু ভুল
না শুধরানো ভালো।
চিঠিদের আসলে কোনও
ঠিকানা হয় না।
কিছু উত্তর প্রশ্নচিহ্নসমেত
শেষ হয়। তাই প্রশ্নেরা
কমে আসে। কালবৈশাখীতে
ধাক্কা খাওয়া গোধূলির
আলোর মত। শেষ চিঠিতে
খোঁপার মত ঝুলে
থাকে একটি জলপাই
চন্দ্রবিন্দু।
এখানে বিনোদন
মানে কেবলই বেতার।
প্রচার তরঙ্গগুলি
ফণিমনসার মত প্রচারবিমুখ।
গ্রীষ্মের নিস্তেজ
দুপুর। মুখিয়ে
থাকা শৈশবের খানকয়েক
দৃঢ মুখ। স্কুল
প্রায় একমাস ছুটি।
তারই রেশ ধরে খুড়তুতো-পিসতুতো
গল্পসফর। দোতলার
সমস্ত ঘর যেন সেই
সফরের টাইমমেশিন।
সন্ধ্যার আহ্নিক
সেরে হরজ্যাঠা
শুয়ে থাকেন খাটিয়া
পেতে। মাধব মন্দিরে
কীত্তন শেষ হব
হব। শহরের উপকণ্ঠে
যে গ্রাম। তার
সমস্ত অন্ধকার
মাতোয়ারা। ব্রজবুলি
ধুনোর আঁচে। মোহন
কাকার দোকান থেকে
উড়ে আসে সলজ্জ
ফুলুরির মোহ। কাদের
বাড়িতে যেন তালের
লুচি ভাজা হয়।
আদিম আদিম ছাতিম
গাছটি ঠিক এইসময়ই
জেগে ওঠে প্রতিদিন।
এইসব মায়াবী সুর
যখন ভারী করে রেখেছে
ছুটির আক্ষরিক
প্রবাহ। লণ্ঠনের
খয়েরি আলোয় পড়া
হয় বই। লাইব্রেরি
থেকে চুরি যাওয়া
বই। সে কোন জমানার
লাইব্রেরি। লাইব্রেরিয়ানের
মতই প্রাচীন। ততোধিক
উদাসীন। তার পোকায়
কাটা পাতা। হলুদ।
পাঠের গুণে আগুন
হয়ে ওঠে। পুরানো
পাতার কড়া মিহি
গন্ধ। মাঝখানে
লণ্ঠন। গোল হয়ে বসে আছে খাতভাঙা
শৈশব। জামবাটি
মুড়ি। সতর্ক কান,
মুদে আসা চোখ আর
নিস্তব্ধ জাবরের
হাপুস হুপুস- এইসব সন্ধের
ঘনত্ব মাপতে পারেননি
কোনও গণিতজ্ঞ।
রাত্রি সহজাত রাত্রিতর
হয়। হরজ্যাঠার
পৈতৃক বেতার তখনো
নিজের খেয়ালে ঘষে
চলেছে ফ্রিকোয়েন্সি।
একটাদুটো ব্যর্থ
যাওয়া ফুলকি। বিচিত্র
সব শব্দের ঠুমরিতে
নেশা নেশা লাগে।
আলো পর্যাপ্ত না
হওয়ায়, বোঝা যায়
না কে কতখানি নেশাচ্ছন্ন।
সেই নেশা কোনও
রাতজাগা পাখির
ডানা ঘেষে সাংঘাতিক
হয়ে ওঠে আগামী
দুপুরবেলা। নিস্তেজ
দুপুরবেলা। নিমগাছের
ডালে কী একটা বাতাস
এসে লাগে। বেতার
বেতার বাতাস। শুনছেন।
গল্প "পথের দাবী।"
পরবর্তী অংশ। কতদিন
সেই প্রচারতরঙ্গের
কাটাকুটিতে ছিঁড়ে
ছিঁড়ে আলগা হয়ে
যায় সমস্ত উদ্যমে
পাঠরত দরদী নারীকণ্ঠ।
মনের কত লুকানো
অনুভূতি শোনা হয়ে
ওঠে না। স্বয়ং
চরিত্রের কণ্ঠে।
কতক্রোশ দূর থেকে
ভেসে আসা ভারতী।
অপূর্ব। ডাক্তার। সুমিত্রা।
বর্মার অতুলনীয়
পটভূমিকা। ঘড়িধরে
তিরিশ মিনিট ব্যাস।
তাও তত মসৃণ না।
লণ্ঠনের কাঁচাপাকা
আলোর মতই অস্পষ্ট
অথচ সম্ভাবনাময়।
সম্ভাবনাময় শৈশবের
সেইসব বেতার বেতার
বাতাস। সান্ধ্য
পল্লীগ্রাম। বাতাসের
আবেশে আলগোছে পড়ে
যাওয়া ফুলদানির
মত বাংলা ভাষা।
সম্ভাবনাময়। সেইসব
চুরি যাওয়া বই।
পালা করে করে গল্পপাঠ।
জামবাটি মুড়ি।
লাইব্রেরি। ওরফে
উদাসীন লাইব্রেরিয়ান।
আজকাল আছেন
কেমন?
Copyright ©
2020 Rishi
Sourak Aranya Published 1st Sep, 2020.