তাহিতি ফারজানার কবিতা

 

তাহিতি ফারজানা নতুন সহস্রাব্দের দ্বিতীয় দশকের কবি। সিলেটের বাসীন্দা। লেখালিখি শুরু বিশে পা দেবার আগেই। অনেক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ওঁর কবিতা স্বাতন্ত্র্যের স্পষ্ট নমুনা সর্বত্র। ফরজানার পর্যবেক্ষণশক্তি যেমন বলবার মতো, তেমনি গুণ কবিতার মধ্যে এক মৃদু কৌতুকের বীজ এবং এক অনচ্ছ ট্র্যাজেডির খোঁজ রেখে দেওয়া। প্রথম কবিতাপুস্তক - ‘আদ্যোপান্ত হৃদয় যাপন’ (২০১৫)। গত দশকে ওঁর লেখালিখি থেকে কিছু নির্বাচিত কবিতা এই সংখ্যায়। 

 

 

সন্ধ্যা

 

খাদ্যাভ্যাস পাল্টে ফেলার মতো সহজ নয় পৌঁছানো

যেখানে সব কণ্ঠস্বর এক শোনায়।

 

সন্তর্পণে জ্বলে উঠে গাড়ির হেডলাইট

ঘাসে গেঁথে থাকা ক্রুশ সম্ভাষণকাতর!

 

দূরবর্তী সময়, নিকট অভিজ্ঞতা-

সম্পর্ক মানে গোলপোস্টের দিকে ধেয়ে যাওয়া নয়।

 

আকাশপথ খুঁড়ে মুঠো মুঠো চোরাসাঁতার

বয়ে আনে ধীর সন্ধ্যা।

স্যান্ডেল পড়ে থাকে অসহ্য নীলচে।

পা রঙান্ধ; সুরভর্তি ভায়োলিন।

 

 

শিল্পীর প্রতি

 

মাংসের নিচে ঢেকে রাখে শুভ্র অভিমান, মানুষেরা,

স্ব স্ব নেশায় ভুলে থাকে সম্বোধন।

মেকআপ তুলে ফেলো

আদিম মুখশ্রীতে ভিড় করে বসুক দুর্বল পঙক্তি

জন্মকথা মেশানো দিনে নির্বাসিতের আশ্রয় হও তুমি।

 

আশ্চর্য রঙে ছলকে উঠুক মদের গ্লাস

মুখভর্তি ধোঁয়া, কুয়াশা, এরপর ছোঁয়াচে শীত।

আগে বর্ষা থামাও, থামাও গাড়ির হর্ন

পদধ্বনি ভেঙে প্রশ্নবোধক চিহ্ন

ভুলে থাকো এই নৈরাশ্য, আত্মসমর্পণ—

 

বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পথ হাঁটছে তোমার দেখাদেখি।

 

 

নিজেকে বলি

 

নিজেকে বলি-

পরিশ্রমী দিনের আঁচে

চিন্তাপ্রহৃত হও ভেতরে।

 

এবং চুপচাপ

ক্ষয়ে গিয়ে পরখ করো ধার।

 

মানুষের মুখ

শব্দের মধ্যে খেলে গেলে

আপোষভঙ্গিতে এঁকো না প্রতিকৃতি।

 

এবং পাথরের ফিসফিসানি ক্ষুধা

উড়াও আগন্তুক ফুঁয়ে।

 

নিজেকে বলি-

কান্নাস্থিত নুন ঊর্ধ্বগামী।

লিখে রাখো।

 

 

স্লিপওয়াক

 

কাঁথার সেলাইগুলো

মানুষের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে

জ্বরগ্রস্ত জিভের স্বাদ

আমাকে হাঁটিয়ে নিয়ে চলে

বাস্তব দরজার পেছনে-

যেখানে প্রতিকথারা থাকে।

 

অন্ধকার বেলুনের ভেতর থেকে

আমি শিষ দিতে থাকি

প্রচ্ছন্নতায় তলিয়ে যেতে থাকি

নিজস্ব বাথটাবে।

 

টের পাই

জোছনার দাগ লেগে

আলচে হয়ে আছে বিছানাপত্র।

ঘুমের ভেতর।

 

 

ছায়াপথ

 

একটি বিষণ্ণ বেলুন

নিজেকে প্রদক্ষিণ করে বারবার-

 

বঞ্চনার কথা বলতে গিয়ে

তুমি আরও কিছু গুপ্ত বঞ্চনা

তৈরি করো নিজের খেয়ালে।

কাঁটা তুলতে গিয়ে

বেশুমার পুঁতে রাখো—

আরও কিছু দ্যুতিময় কাঁটা।

 

সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে ফুরিয়ে যাওয়া বিকেল

দাঁতের আড়ালে হাসি লুকিয়ে

মিশে যায় উৎসের কাছে।

 

পরান্মুখ বিকেল ট্র্যাজেডির হাতকড়া পড়ে

ফিরে যায়।

মূর্তমান অন্ধকারের জাল গিলে নিলে দৃশ্যপট

আকাশে ভাসে উদ্বেগ মেশানো ডানারা!

 

নিঃশব্দ পলক ফেলে তখন

কেউ বুনে যায় শব্দের অধিক কথার নকশা—

 

জেনেছি, তার বাকশক্তি চুরি করে

দূরে উজ্জ্বল হয়ে আছে ছায়াপথ!

 

“ঝরে গেছি”

 

তির্যক বৃষ্টি এলে মনে পড়ে

একদিন ঝরে যেতে চেয়েছিলাম।

 

কলার কাদি জড়িয়ে শুয়ে ছিল যে সাপের ফণা

বেদম প্রহারে তাকে ফেলে দেয়া হল ঘাসে

এভাবে সমস্ত মৃত্যুর সাক্ষী থাকে জীবিতরা

আড়ালে এবং প্রকাশ্যে—

 

রক্তের ভেতর প্রবাহিত

বাতাস আর সমুদ্রের সম্মিলিত গর্জন।

 

ঘুমন্ত লাইটহাউজ

যেন প্রজ্বলিত তারাগাছ এক—

বেদনাকে অস্বীকার করে।

 

ওহে মৃত্যু,

তুমি কি সাদা?

নুয়ে পড়ো জবার কেশরের ঢঙে!

আকণ্ঠ উন্মাদ বৃষ্টি ফুরোলে মনে হয়—

ঝরে গেছি।

 

 

দূরত্ব

 

গাছের বাকল কেটে নেয়া ক্ষত থেকে রাত বাড়ে,

বাড়ে শহরের হৃদস্পন্দন।

ইমারত জুড়ে একে একে

বৈদ্যুতিক বাতির নিভে যাওয়া দেখি।

কোথাও প্রেম, কোথাও অনাহূত শোরে

খুন হয় নৈঃশব্দ্য।

সবাই ঘুমালে সেইসব দূরবর্তী সংসারেরা

অবিকল মানুষ হয়ে হাঁটাচলা করে।

 

দূরত্ব এক সর্বভুক পিরানহা—

এ কথা ভেবে

সর্বোচ্চ দূরত্বের দিকে ঢিল ছুড়তে থাকি।

 

দূর তখন সূর্যের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা রাবার বন,

মহিষের কাধে ঝিম মেরে বসে থাকা কাক,

জল আর তীরের বিভেদ মোছা কোন পরিসীমা।

 

ঘন রাতের পিঠে হাত রেখে

কাঠমিস্ত্রির মত দূরত্বকে বার্নিশ করি।

চকচকে আরও...

 

দূরে মুহুর্মুহু ভেঙে পড়ে দৃশ্য।

 

 

রাগের শরীরে

 

রাগের শরীরে কেউ রেখে গেছে

চুম্বকের আকর, আলোকমঞ্চ;

সেলাই করা স্বপ্নের পাশে

বিথোভেন, যেন বয়সহীন বনভূমি,

বাজান নিজেরই দ্বন্দ্ব-মধুরতা।

তন্ময় হয়ে শিশুগাছ গুলো

সার বেঁধে দাঁড়িয়ে যায়।

 

রাগ জমে জমে পাহাড়চূড়া

রাগ জ্বলে-নিভে ডুবোজাহাজ

জপমালা হাতে ছুটে আসি,

ট্যাবু ভেঙে আসি

আন্তরিক আরোহী।

 

রাগের শরীরে কে ফেলে গেছে

চোরাঘ্রাণ ছাতিমের!

 

Copyright © 2020                                       Tahiti Farjana                                     Published 1st Apr, 2020.

 

gadha-transparent