অনিন্দিতা
ভৌমিকের কবিতা
অনিন্দিতা
ভৌমিকের জন্ম ১৯৮৬
সাল। বড় হয়ে ওঠা
প্রায় সমগ্র উত্তরবঙ্গ
জুড়ে। উদ্ভিদবিদ্যা
বিষয়ে স্নাতকোত্তর
করেন উত্তরবঙ্গ
বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে। বর্তমানে
কর্মসূত্রে জলপাইগুড়ি
জেলার বাসিন্দা।
জেলা বিচারবিভাগের
অধীনে কর্মরত।
প্রথম বই –‘প্রামাণ্য
কিছু নেই’ (কৌরব,২০১৯)।
কবিতা বলতে বোঝেন
নিজেকে খুঁজে পাওয়ার
অভিমুখ। সেখানে
হয়তো জোলো হাওয়া,
হয়তো পৌরাণিকতা,
হয়তো মনোযোগ দিয়ে
লক্ষ্য করা নিজের
অনুনাদী কন্ঠস্বর।
আর প্রবেশের চেষ্টা
অধ্যায়ের সেই মূল
বিন্দুটিতে। নিজের
অস্তিত্বের ভাঙাচোরা
প্রত্নতত্ত্বে...
বীক্ষণ
– a journey to the innermost self
সমস্ত
গতি যদি বৃত্তাকার
হয়, তাহলে
সূচনা আর শেষও
একই বিন্দুতে। অথচ রূপান্তর
কিছু ঘটেই যায়। পাথুরে স্তরের
মধ্যে জমে থাকে
জীবাশ্ম। যার প্রজাতি
কোনোকালে শরীরী
অবস্থায় ছিল। উজ্জ্বল খোলসের
নিচে অবিকৃত ছিল
হাড়ের কাঠামো।
শোকতপ্ত
হাতে ডালপালা সরিয়ে
সমুদ্রের কথা ভাবি। তার জোলো
হাওয়া, বালিতে ডুবে
যাওয়া পায়ের কথা। বহুদূর
নোনা গন্ধে হয়তো
পৌরাণিকতা লিখে
রাখে। কোথাও ঋজু
করে তোলে নির্জন
অতীত। যখন ক্ষুধিত
ও পরিত্যক্ত। যখন
বহুরূপের সবকটা
অবয়বই পূর্ণতায়।
আর তাকে চিৎকার
করে ডাকছি। মনোযোগ দিয়ে
লক্ষ্য করছি নিজের
অনুনাদী কন্ঠস্বর।
তাহলে ঠিক কতটা
খুঁজে পাওয়া নিজেকে?
কতটা অভিমুখ ঘুরিয়ে
নিলে উঠে আসবে
তলদেশে হারিয়ে
ফেলা গল্পের সূচনা?
অথবা নির্যাস রেখে
যাওয়া পুনরাবৃত্তির
মুখ, অজস্র যুদ্ধের
ইতিহাস। দালান-খিলানভিত্তিক
এই তত্ত্বাবধান
সরিয়ে অনুপ্রবেশের
চেষ্টা শুধু অধ্যায়ের
সেই মূল বিন্দুটিতে।
নিজের অস্তিত্বের
ভাঙাচোরা প্রত্নতত্ত্বে...
মূলত এক ফিরে
আসার শহর। দাঁড়িয়ে আছে
তার টুকরো, অনুষঙ্গ,
গলি, রাস্তা ও নিজস্ব
ধারণা নিয়ে। যেখানে
সময় ধাপে ধাপে
প্রস্তরতার কথা
বলে। অন্ধকারের
শেষে তুলে আনে
নীরব জলের রেখা।
বহমান নৌকার সারি।
পাতার
পর পাতা খুঁজি
নিজের ভেতর। কোলাহল
থেকে দূরে খুঁজে
নিতে চাই জ্ঞাত
বিষয়ের যৌক্তিকতা।
বোঘাজকোই লিপির
গায়ে খোদিত বৈদিক
মন্ত্রের সূত্র।
সভ্যতার সূচনা
যাকে অপৌরুষেয়
বলে ব্যাখ্যা করে।
#
ভাষা বলতে
দৃষ্টির ভেদ্যতাই
তুলে ধরেছি
প্রাচীন বাসস্থানের
গভীরে
চিত করে সমাধি
দেওয়ার রীতি
সাদা কাফনের
আড়ালে উত্তরে মাথা
রাখে
আয়তকার লিপির
ভেতর
তুলে আনে নভদাতোলি
গ্রাম
তিসি, মুসুর
এবং গর্ভলক্ষণে
শরীরী সাক্ষ্য
বহন করে
#
পুরনো গতিপথের
দিকে তাকিয়ে থাকছি
এবার
অথচ পুরনো
অংশের ছিঁটেফোঁটা
খুঁজি
সময়ের দৈর্ঘ্য
অনুসারে খুঁজি
জড়িয়ে যাওয়া
পঙক্তি
শ্রৌত্র,গৃহ্য,শূল্ব
ও ধর্মে বিভক্ত
কল্পসূত্রের
ভূমিকা
দশকর্ম বিধি
থেকে দূরে
সমাধির ওইপারে
কোথাও একটা
অনিশ্চিত জায়গা
তোলা থাকে। পৃষ্ঠার
শেষে লিখে রাখা
অসম্পূর্ণ মতবাদ।
চিন্তা ও উপকরণের
আরেকটু মনোযোগ
দাবী করে। তাম্রপাত্রে
ফুটিয়ে তোলে স্থানীয়
অলংকরণ পদ্ধতি।
একটি বৃত্তের সাহায্যে
সমস্ত শূন্যতাকে
আবদ্ধ করার ধারণা।
গোল বারান্দা,
জানালা, উঠোন, দরজা,
চত্বর পেরিয়ে অনেকটা
দূরে, সরু সুড়ঙ্গের
কাছে।
আর ধূলো
ওড়ে রুক্ষ বাতাসের
দিনে। তারিখের
গায়ে লেগে থাকে
মধ্যভারতীয় দিন।
হাতের উপর হাত
রেখে ভাবে অনির্দিষ্ট
সমীকরণের কথা।
অজ্ঞাত রাশিকে
প্রকাশের জন্যে
দেবনগরী হরফ ব্যবহারের
কথা।
#
এই যে সংখ্যার
রিক্ত হয়ে যাওয়া
দীর্ঘ রেখা
ধরে অবসরজাত শরীর
তার আশপাশ
মনে নেই
শুধু নিমগ্ন
দু’টো চোখ
ফুটে ওঠে শিল্পীর
আঙুলে
ছায়া পড়ে
বিগতকালের
সঙ্গতে বেজে যায়
অনুচ্চারিত
অক্ষর
#
আর আমি তো ছুঁড়ে
ফেলা পাথরের কথা
বলতে চেয়েছি
অধিকৃত সিন্ধু
অঞ্চলের মধ্যে
ছড়িয়ে দিতে
চেয়েছি
জগতের ঐশ্বরিক
পরিচয়
তটরেখা ধরে
ধরে
ঈষৎ গান্ধার
সমুদ্রের ঘ্রাণ
#
যেভাবে প্রতিটি
লাইনের দিকে মনোযোগ,
আগের ও পরের লাইনকে
অস্পষ্ট করে তোলে।
অথচ ভাষ্যকার মনোনিবেশ
করেন। বিভোর হয়ে
অনুভব করেন নিউক্লিয়
অম্লের তীব্রতা।
বর্ণ,স্বাদ,গন্ধের
থকথকে উপস্থিতি।
শুধু হেঁটে যাওয়ার
জন্যেই কয়েক ঘন্টা। আর স্মৃতির
বিস্তার নয়। বরং
তার তীক্ষ্মতা
নিয়ে ভাবি। হাত
রাখি নিম্নতম বিন্দুতে। যেন অমোঘ
যুক্তির দিকে মুখ
করে দাঁড়ানো সংলাপ
ঠেলে দিচ্ছে এক খননকার্যের
দেশে। বৌদ্ধ বিহারের
ধ্বংসস্তুপে আবিষ্কৃত
সাতটি পান্ডুলিপির
মধ্যে। যাদের মূল কাঠামোতে
পরিবর্তন দেখা
যায়। নিবিষ্ট
আলোচনার উপর দেখা
যায় তাপ ও বাকশক্তির
প্রভাব।
#
ক্ষণস্থায়ী পর্যায়ের
দিকে তাকাচ্ছি
এবার
মূল পথের বাইরে
একটানা খিলান
দ্রাবিড় রীতি
অনুযায়ী সোনালি
ত্রিকোণ জড়িয়ে
রাখছে
প্রতিটি অংশে
ভরিয়ে রাখছে জাতকের
রূপ
প্রজ্ঞা ও করুণার
সবিশেষ পরিচয়
#
আর একটা অধ্যায়
এভাবে যৌথতার নামে
হোক। খন্ডচিত্রের
দিকে তুলে রাখা
থাক এই জবজবে ভোর। সূঁচের
ডগায় লেগে থাকা
জীবন্ত আয়ু। ফলে
নিভৃতি পরে থাকে। মৃদু
চেতনার ভেতরে উঠে
আসে জৈন শৈলীর
দৃশ্য। যেখানে
বিচরণ ছিল। পাশ
থেকে দেখানো চোখের
একটি ছিল সামান্য
উদগত।
চিহ্ন তো পরিচয়কে
ত্বরাণ্বিত করে। একটা সামগ্রিক
রূপ নিয়ে উপস্থিত
হয় সামনে। কিন্তু বিষয়ের
মধ্যে যদি অপূর্ণতা
থাকে, পড়ে থাকে ভাঙা
সিঁড়ি অথবা অস্পষ্ট
নির্দেশের ব্যবহার,
তাহলে পূর্ব-অভিজ্ঞতা এবং
কল্পনা তাকে ভরাট
করতে চায়। পরিচিত ঘরের
মধ্যে দাঁড়িয়ে
বুঝে নিতে চায়
ঠিক কোথায় দরজা
শুরু হয়েছে। বিষয়ের গায়ে
কীভাবে রাখা হয়েছে
নিঁখুত বাক্যের
বিরতি। অথবা
সমস্ত শিরা। জট পাকানো। নাভির আরেকটু
গভীরে …
#
যা
কিছু লিখতে পারি
না তাকেই গেঁথে
নিতে চাই
রেখে
যাওয়া সাক্ষর, খোদাই ও
দেওয়ালচিত্র থেকে
তুলে নিই শিল্পীর
প্রকৌশল
পাথুরে
ভূমিভাগের গোড়ায়
নিয়োজিত শ্রমিক
কশেরুকা
ভেদ করে ফুটিয়ে
তোলে ধূলোমাখা
চীবর
দু’টো বিন্দুর
মাঝে টানটান সন্তানের
মুখ
#
ভাঙনের
প্রবৃত্তি নিয়ে
লিখি
পজিটিভ-নেগেটিভ
কাটাকুটি করে দেখি
মোট
সৃষ্টির পরিমাণ
আসলে
একটা মুহূর্ত দিয়েই
তৈরি
একটা
জৈব রাসায়নিক-তত্ত্ব
ব্রেইলে
হাত বুলিয়ে
যার
সজীবতা প্রমাণ
করা যায়
এই
ঘর এই আদি-উপকথার
দিকে তাকিয়ে
উচ্চারণ
করা যায় তার দোফলা-স্নায়ুর
হদিশ
#
যতক্ষণ
এই শহরে প্রবল
শৈত্য, নিবিড়তাও
[ নোট:
বোঘাজকোই
লিপি – সময়কাল
১৪০০ খ্রীঃ পূঃ।
মধ্যএশিয়ায় আবিষ্কৃত
প্রাচীন লিপি।
যার গায়ে খোদিত
সূত্রের মধ্যে
চারজন বৈদিক দেবতা
–ইন্দ্র,বরুণ,মিত্র,নসত্য
(Nasatya)-এর
উল্লেখ পাওয়া যায়। এই
লিপি আর্যদের মধ্যএশিয়াগত
উৎপত্তির সপক্ষে
যুক্তি দেয়।
নভদাতোলি – খ্রিঃ
পূঃ দ্বিতীয় সহস্রাব্দ
থেকে তৃতীয় সহস্রাব্দের
মধ্যে মালব উপত্যকায়
নর্মদা নদীর তীরে
গড়ে ওঠা গ্রাম।
অপৌরুষেয় – বেদ-কে
অপৌরুষেয় বলে অভিহিত
করা হয়। মনে
করা হয় যে বেদ সৃষ্টিকর্তা
ব্রহ্মার মুখ থেকে
সরাসরি নির্গত
হয়েছে। কোনো
মরণশীল প্রাণী
তথা পুরুষ এটি
রচনা করেনি।
কল্পসূত্র – বেদাঙ্গকে
‘সূত্র
সাহিত্য’ বলা হয়। যার
মধ্যে ছয়টি সূত্র
ও ছয়টি দর্শন রয়েছে। ছয়টি
সূত্রের একটি হলো
কল্পসূত্র। যা
শ্রৌত্র, গৃহ্য, শূল্ব
ও ধর্মে বিভক্ত। এরমধ্যে
গৃহ্য সূত্রে আছে
গৃহীর জীবনযাপনের
নিয়ম ও তার
দশকর্ম বিধি। ধর্মসূত্রে
আছে সমাজ ও রাষ্ট্র
সম্পর্কে অনুশাসন। পরবর্তীতে
এর উপর নির্ভর
বহু স্মৃতিসাহিত্য
গড়ে ওঠে।]
Copyright ©
2020 Anindita Bhowmik Published 1st Apr, 2020.