নদীমাতৃক
সভ্যতায় চলে নানা
রকমের ‘জীবনবৃত্ত’।
সেই রকমই ভাবা
হয়। নদীপাড়ের
কাদা তুলে এনে
মূর্তি গ’ড়ে,
তার মধ্যে
প্রাণ প্রতিষ্ঠা
ক’রে
আমরা আরাধ্যা দেবীকে
নির্মাণ করি। তাঁকে
ঘিরে আনন্দ উৎযাপন,
দান-ধ্যান,
সিঁদুরখেলা,
ক’দিনের মহোৎসব।
তারপর পোড়া মাটির
আবাহিতা প্রতিমাকে
আবার সেই নদীতেই
বিসর্জন দেওয়া,
সেই তিনভাগের
জীবনরূপিনী জলে
ফেলে দিয়ে, মাটিকে
কাদার জীবন ফিরিয়ে
দিয়ে বৃত্ত সম্পূর্ণ
– ‘দ্য
সার্কল অফ লাইফ’। কিন্তু
মানব বা শিল্পের
জীবন কি বৃত্তাকার?
সত্যিই? এক জায়গা
থেকে শুরু করে
আবার সেই একই জায়গাতেই
ফিরে আসা? যাত্রাপথের
যে কোনো তিনটে
বিন্দু সে যাত্রার
সমীকরণ মেনে চলে?
না কি এক কুণ্ডলীর
আকারে শুরু হয়
সমস্ত পুনর্চক্র,
উপবৃত্ত, অধিবৃত্তাকারে,
এক হেলিকাল প্রয়াসে
মূলের কাছে ফিরে
ফিরে আসতে গিয়ে
বেশ কিছুটা দূরে
গিয়ে দাঁড়ানো?
এই সমস্ত
ভাবনা থেকেই শুরু
হয় কবিতাকুণ্ডলীর
ধারণা। একটা পরীক্ষা
করে দেখার লোভ
চেপে যায়। এই সংখ্যা
সেই সম্পাদকীয়
পরীক্ষার নিদর্শন।
কুণ্ডলীকবিতার
প্রস্তাবনা লিখে
বেশ কিছু কবির
কাছে পাঠাই। সকলেই
নারী, সকলেই তরুণী।
কেন নারী? কেন তরুণী?
যুগ ও জেন্ডারের
চলরাশি এই পরীক্ষার
মধ্যে রাখতে চাইনি।
তাতে পরীক্ষার
জাটিল্য কমে। তাছাড়া
এই সব কবিদের সাম্প্রতিক
লেখালিখি ভালো
লাগছিলো। প্রস্তাবনা
কবিরা সকলে পেয়েছিলেন,
রাজি হয়েছিলেন,
কিন্তু কেউ জানতেন
না প্রকল্পে কারা
অংশ নিচ্ছেন। প্রত্যেক
কবিই মাত্র একটা
কবিতা পান। তার
থেকে লেখেন আর
একটা কবিতা। এই
পর্যন্ত।
দোলনচাঁপা
চক্রবর্তীর যে কবিতা
দিয়ে এই পরিক্রমা
শুরু হয় সেই কবিতায়
একটা বীভৎসরস বা
macabre তার
নিজস্ব একটা প্রস্রবণ
গড়ে নিয়েছে। একটা
তিন টুকরো
লাশের মধ্যে দিয়ে
দুটো স্টেশন
চলে যায়; খুনীর
ঘাম পড়ে; সিনেমার
পার্পল পর্দা মৃত্যুদৃশ্যের foreboding আনে। তারপর আস্তে
আস্তে এই ডিপ্রেশনকে
কাটিয়ে তোলার,
সহ্য করার আবহাওয়া
গড়ে নেয় কবিতা।
এখান থেকে
শুরু ক’রে জয়শীলা
গুহ বাগচী মৃত্যু, জখম,
খুন ও বীভৎসরসের
কিছুটা গ্রহণ করেও
আরো অনেক বিমূর্ততা
যোগ করেন ওঁর কবিতায়।
জয়শীলা তাঁর কবিতার
নামকরণ করেননি।
দোলন তাঁর কবিতা
শেষ করেছিলেন এক
নিরপেক্ষ জন্ম
ও মৃত্যর প্যালিম্পসেস্ট
মুছে, জয়শীলা সেখানে
নিঃশ্বাসে
মৃত্যুর নড়াচড়া
রেখেও সাহসী,
নতুন স্মৃতির
সোনাটা নির্মাণ
করতে চাইলেন চাঁদের যে
পিঠ মানব-অদৃশ্য,
সেখানে। বেশ কিছু
অধিবাস্তব বা অতিবিমূর্ত,
আপাত-অর্থহীন রূপক
এলো শীত পিয়ানো,
বরফকুচি বা ভাঙাচোরা
ধুলোর মধ্যে। খুব
মুন্সিয়ানায়।
পুনঃচক্রের
রিলে রেসে তানিয়া
চক্রবর্তী’র কবিতা
‘খিদে’য় পৌঁছে যে
জিনিসটা আশ্চর্য
লাগে প্রথমেই সেটা
ওই মৃত্যু, macabre, খুন, জখমের
অভিভাব যা এখনো
পর্যন্ত এক জীবন্ত
অশ্ব, কেবল লাগাম
পাল্টেছে। ছিন্ন শিরা
এখনো অব্দি টিকে
আছে। তানিয়া জয়শীলার
কবিতার নানা দিকবিদিকব্যাপী
বিমূর্ত আবেশকে
নিজের মত সম্পাদনা
করে, পালটে, নতুন
অগ্নিসংযোগ করে
নিজের কবিতাকে
সংহত করে তুলেছেন
অনেকটা। একটা গল্প,
আর সমাজ নিগৃহীতা
এক নারীর দোমড়ানো,
মোচড়ানো, রক্তাক্ত
দেহের দুটো আভাস
যেন আমরা পাচ্ছি
কবিতার শেষে। জয়শীলার
স্মৃতির সোনাটাকে
তানিয়া যেন মুচকে দিয়েছেন,
মধ্যচ্ছদায়
মেধা খসে পড়েছে।
কবিতার
পুনঃচক্রে পরের
কবি অদিতি বসুরায়
তানিয়ার কবিতার
পরের পরিচ্ছেদ
লেখেন তাকে ‘অন্তিমে
এনে’। অদিতির জবানবন্দিতে
‘কবিতাটি
শেষ ডেস্টিনেশনের।
যেখানে জীবনের
গল্প মাথা নীচু
করতে বাধ্য আবহমান
কাল ধরে। আমি সেখান
থেকে শুরু করেছি।
এখানে আর ঘড়ির
প্রয়োজন থাকে না
বলে প্রসঙ্গ এনেছি
ঘড়ি বন্ধ হওয়ার’।
তানিয়া যে শশ্মানের
রূপকল্প এনেছিলেন,
সেটাকেই অত্যন্ত
সুচারুভাবে সম্পূর্ণ
ক’রে অদিতি এনে
ফেলেন এক পূর্ণাঙ্গ
বন্ধত্ব - a well rounded closure - এক জাগতিক
আয়োজনের সমাপ্তি।
‘অন্তিমে এনে’
যেখানে কবিতার
বিষয়ভাবনাকে শেষ
পরিচ্ছেদে পূর্ণচ্ছেদ
টেনে দিয়েছিলেন
অদিতি, সেখান থেকেই
পরের কবি সুস্মিতা
পাল আবার কবিতাকে
কিছুটা খুলেছেন,
undo করেছেন।
যে প্রয়াসে ছিলেন
জয়শীলা, সেই বিমূর্তায়নকে
আরো তীব্র ও আকস্মিক
করে তুলেছেন সুস্মিতা।
অথচ
নাভি, বরফ, খুলি,
কবর, কাঠ, সমাপ্তি – এইসব
মারণমুখী রূপককে
অবলম্বন করেছেন।
তাঁর স্বাভাবিক
কাব্যপ্রবণতায়
সুস্মিতা এখানে
সুনিশ্চিত, একরৈখিক
দৃশ্যকল্পকে কিছুটা
পদার্থবৈদিক অনিশ্চিয়তা
এনে দিয়েছেন। যেন
প্রত্যেকের লেখা
সম্বন্ধে মন্তব্য
করছেন খেলাচ্ছলে
(যদিও আসলে তা কবির
উদ্দেশ্য নয়), এইভাবেই
শেষ পংক্তিতে পড়ি ‘কে কোথায় ছুঁড়েছিল
ওম, মনে
রাখে ব্রহ্মাণ্ডের
সেই বিখণ্ড কণা’।
পরের
কবি অনিন্দিতা
গুপ্তরায়-এর কবিতায়
এসে আমরা দেখতে
পাচ্ছি প্রথমদিকের
সেই ছিন্ন শিরার
রূপক অন্তর্হিত
ঠিক, কিন্তু স্টেশন
তো এখনো রয়ে গেছে,
মৃত্যুর অনেক চিহ্ন
রয়ে গেছে, আরো গাঢ়
হয়ে আবার ফিরে
এসেছে হত্যাদৃশ্য।
তানিয়ার কবিতায়
যে মৃতা মেয়েটির
আভাস পাওয়া যাচ্ছিলো,
অনিন্দিতা যেন
তাকে চেনে। সে
মেয়েটির কাহিনিকে
আবারো জমিয়ে তুলেছেন।
কেবল এই মৃতা নারী
বিবাহিতা। তাঁর
সোনা বাঁধানো
শাঁখা, পলার হাত।
অনিন্দিতার রূপকতায়
বিরাট ঘনত্ব। এক
এক পঙক্তিতে ৩,৪,৫টি
পর্যন্ত উপমা,
একে অন্যের সাথে
বোগির মতো, চেনের
লিঙ্কের মতো জোড়া।
অন্য একটা জায়গায়
ওজনের পরিবর্তনও
লক্ষ্য করি। সাদা
রঙ, বরফের ভার হারিয়ে
থার্মোকলের
হাল্কায় স্বাধীনতা
পেয়ে উড়ে যায় হাওয়ায়;
মৃতা মেয়েটি হয়তো
ছিলো উড্ডীন, হয়তো
একটু ব্যভিচারী,
সমাজবিরুদ্ধ।
কুণ্ডলী
প্রায় শেষ হয়ে
এসেছে, শেষ পর্বের
যাত্রার জন্য ব্যাটন
তুলে নেন সঙ্ঘমিত্রা
হালদার। তিনি
প্রথমেই ধরে রাখলেন
অনিন্দিতার সুষুন্মা
ও সংবেদন।
শেষ দুজন কবি, অনিন্দিতা
ও সঙ্ঘমিত্রা কিছুটা
compression technique ব্যবহার করেছেন
নিঃসন্দেহে। সঙ্ঘমিত্রা
খুব সচেতনভাবেই।
তাঁর এই নামহীন
কবিতায় এসে আমরা
দেখতে পাই মৃত্যু,
হত্যা, মৃতা নারীর
সমাপ্তির প্রকোষ্ঠ
থেকে সঙ্ঘমিত্রা
কবিতাকে বের করে
নামিয়ে নিয়েছেন
নিজের মানসভূমিতে,
যেখানে আত্মপ্রতিকৃতির
এক নতুন বহুরূপ
দেখতে পাই, দেখতে
পাই নিজের
মনেরা এক থেকে
অনেক হয়ে নিজেদের
নিয়ে এক খেলার
প্রলোভনে। নাকি
কবি নির্দেশ করতে
চাইলেন আমাদের
এই পুনঃচক্রিত
কবিতাকে, যে সাত
কবির হাতে হাতে
স্বরূপ থেকে স্বরূপান্তরের
খেলায় মজেছে?
এখান
থেকে আমরা আবার
ফিরে গেলাম দোলনচাঁপা
চক্রবর্তীতে।
সঙ্ঘমিত্রার কবিতা
থেকে দোলন যেটা লিখলেন তাতে
প্রমাণ হয়ে গেলো
হাতে হাতে, শিল্পের
কুণ্ডলী বেঁকে
চুরে এতবার মন
ও মেজাজ বদলে macabre থেকে ‘জানে
আনজানে’ উঠে আসে
‘গোলাপবাগানে’।
আর্যনীল
শীত, সিনসিন্যাটি,
২০১৬